জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শ্রেণির সব বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, অনুমোদন, প্রকাশ ও বিতরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড-এর উত্তরসূরি সংস্থা। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ছিলেন সভাপতি। ১৯৫৬, ১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে কয়েক দফায় পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড-এর কাঠামো পরিবর্তিত হয়। বোর্ডের কর্মপরিধিও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭২ সালের পূর্বপর্যন্ত বোর্ড উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে একই শ্রেণিতে একই বিষয়ের একাধিক পাঠ্যবই অনুমোদন ও প্রচলনের নীতি অনুসরণ করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নবপ্রজন্মের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৭১-১৯৭৭ সময়ে স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির ও বিষয়ের পাঠ্যবই সংশোধন, পরিমার্জন ও পুনর্লেখনের কাজ করে। ১৯৭৬ সালে গঠিত হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি। এ কমিটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের আলোকে ৭ খন্ডে প্রণীত রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করে। সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর এর বাস্তবায়নের ভার বাংলাদেশ স্কুল টেকস্টবুক বোর্ডের ওপর বর্তায়। বোর্ড পর্যায়ক্রমে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ১ম শ্রেণি থেকে ৯ম-১০ম শ্রেণির জন্য রচিত পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করে।
সরকার দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও সুসংহত ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত সাধারণ, কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মাদ্রা্সা শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি উন্নয়ন এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র’ (National Curriculum Development Centre/NCDB)। এ প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন, নবায়ন, উন্নয়ন ও মূল্যায়নের এবং প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। এ প্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্রম উন্নয়নের সমগ্র প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে স্কুল টেকস্টবুক বোর্ডকে সহায়তা ও পেশাগত পরামর্শ দান করতেন। মাত্র দুই বছর পরই সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৩ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র ও বাংলাদেশ স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড একীভূত হয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড নামে পুনর্গঠিত হয়। একীভূত হওয়ার সরকারি অডিন্যান্সে বলা হয়েছে- পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় প্রয়োজনের নিরিখে দেশের প্রণীত শিক্ষানীতির আলোকে মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ের মান, মুদ্রণ ও বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় ও উপযোগী করে তোলা। এ বোর্ডের প্রশাসনিক কাঠামোতে চেয়ারম্যান সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। এছাড়া শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, অর্থ ও প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন ৪ জন সদস্য। এ প্রতিষ্ঠানের লোকবল ৩৯৮ জন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রধান কাজ হচ্ছে: সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় প্রাক্-প্রাথমিক স্তর থেকে প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি উন্নয়ন, সংস্কার এবং পরিমার্জন; প্রত্যেক স্তরের প্রত্যেক বিষয়ের জন্য শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক নির্দেশিকা, পাঠসহায়ক ও পরিপূরক পঠনসামগ্রী প্রণয়ন; শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাক্রম বিস্তার; পাঠ সহায়ক বইয়ের অনুমোদন দান; প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সকল বিষয়ের পাঠ্যবই প্রণয়ন, মুদ্রণ ও সরবরাহকরণ; মাধ্যমিক স্তরের সকল শ্রেণির সকল বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বাজারজাতকরণ; উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজি ও নির্বাচিত বিষয়ের বই প্রকাশ ও অন্যান্য প্রতিটি বিষয়ের একাধিক বইয়ের অনুমোদন দান; এবং নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির কয়েকটি পাঠ-সহায়ক ও পরিপূরক পাঠ্যবইয়ের অনুমোদন দান।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এর প্রধান কার্যালয় ‘পুস্তক ভবন’, ৬৯-৭০ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত। তবে সূচনাতে এর প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকার র্যাঙ্কিন স্ট্রিটে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর এ অফিস স্থানান্তরিত হয় মতিঝিলে। এছাড়া তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে এর কাগজ ও বই সংরক্ষণের জন্য একাধিক নিজস্ব গুদাম রয়েছে। ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে বোর্ডের নিজস্ব জমিতে একটি প্রিন্টিং কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দেশের সর্ববৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা। বোর্ড ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বই ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সর্বমোট ২১ কোটি বই ছাপার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকার ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী স্তরের মতো মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৮ কোটি ৮৭ লক্ষ বইও বিনামূল্যে দেশের সকল শিক্ষার্থীর কাছে বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। [শফিউল আলম]