জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘ আকাঙ্খিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যা মানবাধিকারের যেকোনো ধরণের লঙ্ঘনের ঘটনাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গঠিত। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মানবাধিকার, রাজনীতি এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছিল যার সাথে যুক্ত হয় জনগণের আর্থ-সামজিক কল্যাণের লক্ষ্যে নেয়া মুক্তবাজার ধারণার প্রসারের প্রভাব যা মূলত জনগণের কল্যাণের চাইতে প্রাইভেট সেক্টরের স্বার্থ রক্ষায় অধিক ভূমিকা রাখে। সরকারের এই পরিবর্তিত ভূমিকার দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক অসমতা দেশের ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ্বের বিভাজন তৈরি করে। এ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের জনগণের নিরাপত্তা বিধান এবং অরাজকতা থেকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রকে অধিক সর্তক থাকতে হয়। কিন্তু জনগণের যৌথ ও ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষায় কার্যকর কোনো সহায়ক প্রতিষ্ঠান না থাকায় দেশের পরিস্থিতি সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।
বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে। এ লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন (আইডিএইচআরবি) শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৬-২০০১ সাল নাগাদ মানবাধিকারের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আইনি কাঠামোর খসড়া তৈরির কাজ পরিচালিত হয়। পরে ২০০১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার কমিশন গঠন করার সম্ভাবনা যাচাইয়ের লক্ষ্যে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি মানবাধিকার কমিশন গঠনের আইন প্রণয়নের সাথে সাথে মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি পরিপূর্ণ আইন তৈরিরও সুপারিশ করে। ২০০৩ সালের ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফা আলোচনার পর এই কমিটি একটি খসড়া বিল প্রস্ত্তত করে মন্ত্রিপরিষদে প্রেরণ করে, কিন্তু এই বিলটি মন্ত্রিপরিষদের সভায় উত্থাপন করা হয় নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানবাধিকার কমিশন গঠনের উদ্যোগের ঘোষণা দেয়। ২০০৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদে একটি খসড়া উত্থাপন করে। পরিষদ নীতিগতভাবে খসড়া অনুমোদন করে এবং আইন সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিকে খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদনের মধ্য দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পুনরায় প্রেরণের জন্য আদেশ দেয়া হয়। পুনঃসংষ্কার করা প্রস্তাবটি আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করে এবং ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তা অনুমোদন লাভ করে।
অনুমোদন লাভের পর ২০০৭ সালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশের অধীনে একজন সভাপতি এবং আরো দু’জন কমিশনার নিয়ে ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কাজ শুরু করে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কমিশনের সভাপতি হবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অন্য দু’জন কমিশনারের একজন হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং আরেকজন হবেন মানবাধিকার আন্দোলনের সমর্থক কোনো নারী নেত্রী। অধ্যাদেশ বলে কমিশনের সভাপতি হবেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কমিশনের সদস্যগণ একটি নির্বাচনী কমিটির সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ লাভ করবেন। কমিশনের কোনো সদস্যের বয়স ৫০ বছরের নিচে এবং ৭২ বছরের উর্ধ্বে হবে না। কমিশনের সভাপতি এবং অন্য সদস্যরা তিন বছরের মেয়াদে নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন এবং মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় বারের মতো নিয়োগ লাভ করলে শুধু সেই মেয়াদেই দায়িত্ব পালন করবেন এবং তা পুনরায় আর বাড়ানো হবে না। সদস্য নির্বাচক যে কমিটি, তা গঠিত হবে ছয়জন সদস্যের সম্বন্বয়ে। এদের অন্তর্ভূক্ত থাকবেন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি যিনি কমিটির সভাপতি হবেন, মন্ত্রীপরিষদের একজন সচিব, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতি, আইন বিচার এবং সংসদীয় কমিটির সচিব যিনি কমিটিকে সচিবালয়ের যে সকল সহায়তা প্রয়োজন তা প্রদান করবেন। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি যে পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় পদ থেকে অপসারিত হন, মানবাধিকার কমিশনের নির্বাচক কমিটির সভাপতি এবং অন্য সদস্যবৃন্দ একই পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় তাঁদের কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন। এই কমিশন আইনগতভাবে একটি বৈধ সংস্থা হিসেবে নিজস্ব সিলমোহর এবং স্থায়ী দায়াধিকার এবং নিজস্ব নামে যেকোন মামলায় বাদী বা বিবাদী হবার অধিকার ভোগ করবে।
এই কমিশন অন্যন্য দায়িত্বের সাথে নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদনে দায়বদ্ধ থাকবে:
(ক) জারি করা সুয়োমটো রুলের তদন্ত করা অথবা কোনো ব্যক্তি, রাষ্ট্র অথবা সরকারের কোনো অংশের অথবা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা মানবাধিকারের কোনো লঙ্ঘন অথবা মানবাধিকারের লঙ্ঘন করতে উস্কানি দেয়া বা প্ররোচিত করা এমন কোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিজের করা অভিযোগের অথবা তাঁর পক্ষের হয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির দায়ের করা অভিযোগের তদন্ত করা, এবং
(খ) জারি করা সুয়োমটো রুলের তদন্ত করা অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা মানবাধিকারের কোনো লঙ্ঘন অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নিতে অবহেলা বা উপেক্ষা করা এমন কোনো কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিজের দায়ের করা অভিযোগের অথবা তাঁর পক্ষের হয়ে অন্য কোনো ব্যক্তির করা অভিযোগের তদন্ত করা।
কমিশন কোনো অভিযোগের তদন্তকালে যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাদের বক্তব্যও শুনবে, এছাড়া বাদী এবং তার সাক্ষীদের প্রতি সমন জারি করার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকা যেকোন ধরনের ডকুমেন্ট কমিশনের সামনে উপস্থাপন করার আদেশ দেবার ক্ষমতা কমিশনের থাকবে। সব ধরনের তদন্ত শেষ করে কমিশন যদি অভিযোগটির সত্যতা খুঁজে পায় তাহলে সে সরকারকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অথবা অন্য যেকোন ধরনের আইনি পদক্ষেপ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিতে বলতে পারে যিনি আইনগত ব্যবস্থা অথবা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণকারী বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত আছেন। বিষয়টি সংবিধানের ১০২ ধারার অধীনে নিষ্পত্তি যোগ্য হলে কমিশন নিজে অথবা ক্ষুব্ধ ব্যক্তির পক্ষ হয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে পিটিশন ফাইল করতে পারে। উপযুক্ত মনে করলে কমিশন ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে অথবা তাঁর পরিবারকে স্বল্পকালীন আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের নিকট অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করতে পারে। তদন্ত শেষে কমিশন তার তদন্ত রিপোর্টের একটি কপি ক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিকট অথবা তার প্রতিনিধির নিকট প্রেরণ করবে। এছাড়াও কমিশন সুপারিশমালা সহ তদন্ত রিপোর্টের একটি কপি সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করবে এবং রিপোর্ট গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কমিশনের দেয়া সুপারিশমালার ভিত্তিতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে অথবা পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে তা কমিশনকে অবহিত করবে। কমিশনের প্রেরিত সুপারিশমালার সাথে যদি সরকার অথবা এ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতপার্থক্য ঘটে অথবা এই সুপারিশমালার ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যদি অপারগতা প্রকাশ করে অথবা প্রত্যাখান করে তাহলে কমিশনের নিকট এই সময়ের মধ্যেই তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ এবং কেন তারা এর বাস্তবায়নে অক্ষম এবং প্রত্যাখান করেছে তার কারণ দর্শাতে হবে। কমিশন তার সংশ্লিষ্ট তদন্ত রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করবে এবং এখানে কমিশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত অথবা সুপারিশমালা কমিশনের বিবেচনায় যতটুকু থাকা উচিত ততটুকুই থাকবে। যদি কোনো তদন্ত রিপোর্ট কমিশনের বিবেচনায় গুরুত্বপুর্ণ বলে বিবেচিত হয়, এবং কমিশন যদি মনে করে তদন্ত রিপোর্টের পুরো অংশ বা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত অংশ বিশেষ জনগণের সম্মুখে প্রকাশ করা উচিত, তাহলে কমিশন তদন্ত রিপোর্টের পুরো অংশ অথবা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত অংশবিশেষ প্রকাশ করতে পারে। প্রতি বছর ৩০ মার্চের মধ্যে রাষ্ট্রপতির নিকট কমিশনকে তার কার্যক্রমের বাৎসরিক প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। বাৎসরিক রিপোর্টের সাথে একটি মেমোরেন্ডামও যুক্ত থাকবে, যেখানে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট অন্য কর্তৃপক্ষ কমিশনের প্রদত্ত সুপারিশমালা কার্যকর করার জন্য আইনি উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কেন ব্যর্থ বা অপারগ হয়েছে তার কারণগুলো উল্লেখ থাকবে।
সচিব এবং কমিশনের অন্য অফিসারগণ নিযুক্ত হবেন কমিশনের কার্যাবলি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এবং তাদের কার্যক্রম কমিশনের নির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে যা রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পূর্বেই অনুমোদিত থাকবে। কমিশনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে এবং সরকার কর্তৃক বাৎসরিক যে ফান্ড বরাদ্দ থাকবে তা কমিশন তার বন্টনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের মাধ্যমে সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই ব্যয় করতে পারবে। [কাজী এবাদুল হক]