জাগ গান
জাগ গান বাংলা লোকসংগীতের একটি ধারা জাগ গান। উত্তরবঙ্গের পাবনা, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি জেলায় এই গান প্রসার লাভ করেছে। তবে ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাতেও জাগ গানের প্রচলন আছে। বিভিন্ন লৌকিক দেবতার ও পীরের মাহাত্ম্য কীর্তন করে জাগ গান রচিত হয় এবং তাঁদের পূজা মানত উপলক্ষে গীত হয়। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন পাবনা জেলায় প্রচলিত জাগ গানের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের রাখাল বালকেরা রাতের বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে জাগ গান গায় এবং গৃহস্থের কাছ থেকে চাল-ডাল সংগ্রহ করে পৌষ সংক্রান্তির দিন শিরনি রান্না ও ভোজন করে আনন্দ প্রকাশ করে থাকে। পাবনা জেলায় কৃষ্ণের বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলাবিষয়ক জাগ গানের প্রচলন আছে। মনসুরউদ্দীন ‘কৃষ্ণজাগ গান’ নামে একটি দীর্ঘ পালা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন, যার অংশবিশেষ নিম্নরূপ:
ওমা, দয়া নাইরে তোর,
মা হয়ে কেন বেটায় সদা বলো ননীচোর\
কেষ্ট যায় মা বিষ্ণুপুরে, যশোদা যায় ঘাটে,
খালি গৃহ পেয়ে গোপাল সকল ননী লোটে।
ননী খালো কে রে গোপাল, ননী খালো কে?
আমি ত মা খাই নাই ননী, বলাই খেয়েছে।
বলাই যদি খাইত ননী থুতো আদা আদা,
তুমি গোপাল খাইছ ননী, ভান্ড করেছ সাদা।
শীতের ফসল ঘরে তোলার পর কৃষকের অবসর জোটে। তখন জাগ গানের আয়োজন হয়। সারারাত জেগে গান করা হয়, দর্শকও আনন্দে বিভোর হয়ে গান শোনে। রাত্রির জাগরণ থেকেই জাগ গানের নামকরণ বলে প্রতিভাত হয়। আলকাপ গান, ঘাটু গান ইত্যাদিও সারারাত ধরে পরিবেশিত হয়, তবে সেগুলিকে জাগ গান বলা যাবে না। জাগ গানের নামকরণে বিশেষ উপলক্ষ ও বিষয়গুণ জড়িত আছে। জাগ গান পালাকারে পরিবেশিত হয়। অর্থাৎ তা দলগত সংগীত। প্রধান গায়েন, দোহার, নর্তক, বাজনদার মিলে ১৫-২০জন সদস্য নিয়ে দল গঠিত হয়। জুরি ও তবলা বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়। নাট্যগুণ যুক্ত হওয়ায় এর বিনোদনের মাত্রা অধিক। রংপুরে প্রচলিত রাধার ‘শাক তোলা পালা’ গীতাকারে পরিবেশিত হয়। উক্ত গানে ‘রাধাকৃষ্ণ’ নামের আড়ালে মূলত পল্লললীর যুবক-যুবতীর কথাই বলা হয়েছে; রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক কথা-কাহিনীতে শাক তোলার কোনো প্রসঙ্গ নেই; হাটে দুধ-দধি বিক্রয় করার প্রসঙ্গ আছে। অনুরূপভাবে রাধাকৃষ্ণের ‘মাছ ধরার পালা’র প্রচলন আছে। বস্ত্তত রাধাকৃষ্ণের রূপকে লোককবি চারপাশের বাস্তব মানবজীবনকেই চিত্রিত করেছেন। আর এ কারণে সাধারণ মানুষের কাছে জাগ গানের সাঙ্গীতিক আবেদন বেশি।
রাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও মুসলমানদের পীরকাহিনী নিয়ে জাগ গান রচিত হয়েছে। সোনাপীরের জাগ, সত্যপীরের জাগ, মাণিকপীরের জাগ, গাজীকালুর জাগ ইত্যাদির প্রচলন আছে। সোনারায় বা সোনাপীরের মাহাত্ম্যসূচক জাগ গান প্রচলিত আছে; একে ‘সোনাপীরের জাগ’ বলে। উত্তরবঙ্গে প্রচলিত সোনাপীরের জাগ গানের একটি নমুনা:
সোনাপীর উঠে বলে মাণিক পীর রে ভাই।
এসেছি গোয়ালপাড়া জাহির রেখে যাই \
আগনড়ি পাছ করে বাতানে দিল বাড়ি।
নব লক্ষ ধেনু মল বিশ লক্ষ বাছুরী। ....
সোনা পীর উঠে বলে মাণিক পীর রে ভাই।
মেরেছি গরীবের ধন জিয়াইয়া যাই।
[ওয়াকিল আহমদ]