জলিল, আবদুল
জলিল, আবদুল (১৯৪১-২০১৩) বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আওয়ামীরীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাবেক এম.পি ও মন্ত্রী, ‘নওগাঁর জলিল’ নামে খ্যাত। আবদুল জলিল ১৯৪১ সালের ২১শে জানুয়ারি নওগাঁ সদর উপজেলার (জেলা নওগাঁ) চকদেব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ফয়েজউদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম জরিনা ফয়েজ। ফয়েজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ব্যবসায়ী।
স্থানীয় প্রইমারী স্কুলে আবদুল জলিলের শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৫৭ সালে তিনি নওগাঁ কে.ডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বি.এ (অনার্স) এবং পরবর্তী বছর একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে তিনি ব্যরিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডন যান এবং লিংকন্স-ইন-এ ভর্তিও হন। কিন্তু সেখানে পড়াশুনা সম্পন্ন না করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ১৯৬৯ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। তখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে চলছিল এক বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি।
১৯৭১ সাণের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণে আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণে বাঙালিদের ডাক দিলে, আবদুল জলির নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য লোকজন সংগঠিত করতে শুরু করেন। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করলে, সঙ্গে সঙ্গে আবদুল জলিল প্রথমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতঃপর এক পর্যায়ে উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য তাঁর দলবল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্পের তিনি দায়িত্ববার গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এসহ মোট ৪বার (১৯৭৩, ১৯৮৬, ২০০১ ও ২০০৮) তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি ২বার নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার পর আবদুল জলিলকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৪বছর কারাগারে কাটানর পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তিনি জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দলের অন্যতম যুগ্ন-সম্পাদক, ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য, ২০০২-২০০৭ সাল পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় (১৯৯৬-২০০১) তিনি বানিজ্য মন্ত্রী ছিলেন। ২০০৭ সালে তথাকথিত সেনা সমর্থিত তত্ত্¦ধায়ক সরকার (প্রকৃতপক্ষে সেনাশাসন)-এর সময় অনেকের সঙ্গে আবদুল জলিলকেও গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি অবস্থায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য প্রদান করায়, দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সেনা গোয়েন্দারা তাঁর ওপর অত্যাচার করে জোরপূর্বক ঐ বক্তব্য আদায় করে মর্মে তিনি মুক্ত হয়ে অভিযোগ করেন।
আবদুল জলিল রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ-এর (১৯৯৯) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০২ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৯ সালে তিনি তৃতীয় বারের মত ব্যাংকের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
আবদুল জলিল দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ২০১৩ সালের ৬ই মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃতদেহ নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে আবদুল জলিল ২ স্ত্রী এবং ২ মেয়ে ও ২ পুত্র সন্তান রেখে যান। তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র নিজাম উদ্দিন জলিল (জন) বর্তমানে পিতার নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। [হারনি-অব-রশিদ]
তথ্যসূত্র Member Directory: Ninth Parliament of Bangladesh, June 2004; হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, (বাংলা একাডেমি ২০১৬)