জলবায়ু

জলবায়ু (Climate)  ভূ-পৃষ্ঠের কোনো স্থানের দীর্ঘ সময়ের দৈনন্দিন আবহাওয়ার সাধারণ বা গড় অবস্থা। জলবায়ুর উপাদানসমূহ হলো তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ু, মেঘ,  বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, বায়ুচাপ ইত্যাদি। একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক অবস্থা সে দেশের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ২০°৩৪´ উত্তর থেকে ২৬°৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১´ পূর্ব থেকে ৯২°৪১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। পর্বতময় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ব্যতীত দেশটি মূলত সুবিস্তৃত সমভূমি দ্বারা গঠিত। উত্তর-পূর্বে আসামের পর্বতমালা, উত্তরে মেঘালয় মালভূমি ও অধিকতর উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি ও গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের বিস্তৃত ভূমি বাংলাদেশকে ঘিরে রয়েছে।

বাংলাদেশের জলবায়ু সাধারণভাবে ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাপ, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, নাতিশীতোষ্ণতা এবং সুস্পষ্ট ঋতুগত বৈচিত্র্য। দেশটির জলবায়ুর সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় দিকটি পরিলক্ষিত হয় গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমের স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পরস্পর বিপরীতমুখী বায়ু প্রবাহে, যা দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের বায়ুপ্রবাহ ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে বছরে সুস্পষ্ট তিনটি ঋতুর উপস্থিতি চিহ্নিত করা যায় যথা শুষ্ক শীতকাল যা নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়; মার্চ থেকে মে পর্যন্ত স্থায়ী প্রাক-মৌসুমি বায়ূপুর্ব গ্রীষ্মকাল; এবং জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত বর্ষাকাল। এ ছাড়াও মার্চ মাসটিকে বসন্ত ঋতু এবং মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত সময়কে হেমন্ত ঋতু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের পশ্চিম-মধ্যভাগে প্রথমে শুষ্ক ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং প্রায় চার মাসকাল এখানে এ ঋতু বিরাজমান থাকে। এরপর তা ক্রমশ পূর্ব ও দক্ষিণভাগে অগ্রসর হয় এবং মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণপ্রান্তীয় এলাকা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়। এখানে এ মৌসুমের ব্যাপ্তিকাল এক মাসের মতো। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি উচ্চচাপ কেন্দ্র অবস্থান করে। এ উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে একটি শীতল মহাদেশীয় শুষ্ক বায়ুপ্রবাহ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

প্রাক-মৌসুমি বায়ুর পূর্ববর্তী গ্রীষ্মকালের বৈশিষ্ট্য হল, অধিক তাপমাত্রা ও বজ্র বিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টির ঘটনা। এপ্রিল মাসকে উষ্ণতম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এ মাসে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা ২৭° সেলসিয়াসে এবং পশ্চিম-মধ্যভাগে তা ৩১°সে-এ পৌঁছায়। পশ্চিমাঞ্চলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা কখনও কখনও ৪০°সে পর্যন্ত উঠে থাকে। এপ্রিল মাসের পরে আকাশ ক্রমশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কারণে আর্দ্রতা বেড়ে যায়, ফলে তাপমাত্রায় তার প্রভাব পড়ে। প্রাক-বর্ষা মৌসুম মূলত একটি পরিবর্তনশীল পর্যায়। এ সময় উত্তর অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা শীতকালীন বায়ুপ্রবাহ ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুর বা বর্ষা মৌসুমের (জুন-সেপ্টেম্বর) দক্ষিণা বা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ মৌসুমের শুরুতে বায়ু না খুব তীব্র হয়, না স্থায়ী হয়। তবে এ মৌসুমের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর গতিবেগ যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি তা অধিক স্থায়ী হয়ে ওঠে। প্রাক-বর্ষা মৌসুমের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তর -পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত একটি সংকীর্ণ অনিয়মিত বায়ুপুঞ্জ বিস্তৃত হয়। এ সংকীর্ণ অনিয়মিত বায়ুপুঞ্জটি উচ্চতর গাঙ্গেয় সমভুমি থেকে আসা উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ুপ্রবাহ এবং  বঙ্গোপসাগর থেকে আগত উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুপ্রবাহের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করে। ঋতুর অগ্রসরতার সঙ্গে সঙ্গে এ বায়ুপুঞ্জ অঞ্চলটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যায় এবং মৌসুমের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে এর চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। এর মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ু প্রবাহের ক্ষেত্র তৈরি হয়। গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে যুগপৎ আগমনকারী বর্ষা ঋতু দক্ষিণা অথবা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ, অত্যধিক আর্দ্রতা, ভারি বৃষ্টিপাত এবং মাঝে মাঝে কিছু শুষ্ক দিনের বিরতিসহ একটানা কয়েকদিন বৃষ্টিপাত প্রভৃতি ঘটনা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। বঙ্গোপসাগর থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ক্রান্তীয় নিম্নচাপের প্রভাবে এ মৌসুমে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে।

বায়ুমন্ডলীয় চাপ এবং বায়ুপ্রবাহ  শীত ও গ্রীষ্মের ঋতুগত বৈপরীত্য দ্বারা বায়ুমন্ডলীয় চাপ ও বায়ুপ্রবাহ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে থাকে। শীত মৌসুমে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি উচ্চচাপ কেন্দ্র অবস্থান করে। এ উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে একটি শীতল বায়ুস্রোত পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত হয় যা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ বায়ুপ্রবাহ দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের শীতকালীন মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের একটি অংশ। এভাবে শীতকালে দেশের অভ্যন্তরে বায়ু সাধারণত উত্তর অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে ভূ-পৃষ্ঠের প্রচন্ড উত্তাপে ভারতের পশ্চিম-কেন্দ্রভাগ জুড়ে একটি নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে বঙ্গোপসাগর থেকে একটি উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুস্রোত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উল্লিখিত নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়। আরব সাগর থেকেও ভারত অভিমুখী অনুরূপ বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। এ বায়ুপ্রবাহ উপমহাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের একটি অংশ। তবে তা বাংলাদেশ ভূখন্ড পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে নিস্তেজ হয়ে যায়। স্বভাবতই, গ্রীষ্ম মৌসুমে বাংলাদেশে প্রবাহিত বায়ুপ্রবাহের দক্ষিণা প্রবণতা বিদ্যমান থাকে, তথা এসময় বায়ু দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম অথবা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। তবে ঋতুর পরিবর্তনশীল পর্যায়গুলিতে যেমন, বসন্ত ও হেমন্তকালে বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তনশীল থাকে। সাধারণত, শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালের বায়ুপ্রবাহের শক্তি অপেক্ষাকৃত তীব্র হয়ে থাকে। শীতকালে বায়ুপ্রবাহের গতিবেগ সাধারণত ৩-৬ কিমি/ঘণ্টা হয়ে থাকে, আর গ্রীষ্মকালে এ গতিবেগ থাকে ৮-১৬ কিমি/ঘণ্টা। বায়ুমন্ডলের গড় চাপ জানুয়ারি মাসে ১,০২০ মিলিবার এবং মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা ১,০০৫ মিলিবার পর্যন্ত বজায় থাকে।

তাপমাত্রা  জানুয়ারি শীতলতম মাস। তবে এসময় ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট শীতকালীন শীতল বায়ুপ্রবাহ দেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে পৌঁছতে পৌঁছতে এর তীব্রতা অনেকাংশে হারিয়ে ফেলে। জানুয়ারিতে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গড় তাপমাত্রা থাকে প্রায় ১৭°সে এবং উপকূলীয় এলাকায় তা ২০°-২১°সে-এ বিরাজ করে। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে এবং জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে দেশের সর্ব উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অংশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা একেবারে হিমাঙ্কের কাছাকাছি ৪° থেকে ৭° সে-এ নেমে আসে। শীতকাল এগিয়ে গিয়ে প্রাক-মৌসুমি উষ্ণ ঋতুতে উত্তরণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এপ্রিল মাসে তা সর্বোচ্চে পৌঁছায়। এপ্রিলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গড় তাপমাত্রা থাকে প্রায় ২৭°সে এর মতো এবং সর্বপশ্চিম-কেন্দ্রীয় অংশে এ তাপমাত্রা থাকে ৩০°সে এর মতো। রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া জেলার কিছু কিছু স্থানে গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০°সে কিংবা তারও অধিক উঠে থাকে। এপ্রিল মাসের পরে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলিতে তাপমাত্রা সামান্য হারে হ্রাস পেতে থাকে। এ সময়ে বর্ষা মৌসুমের আবির্ভাব ঘটে। প্রাক-বর্ষা মৌসুমের শেষদিকে আকাশে মেঘ জমতে থাকলে তাপমাত্রার সঙ্গে আর্দ্রতার সংযোগ ঘটে। এক ধরনের ভ্যাপসা আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। জুলাই মাসে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা থাকে ২৭°সে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তা বৃদ্ধি পেতে পেতে ২৯°সে-এ পৌঁছায়।

আর্দ্রতা  বাংলাদেশে প্রায় সারা বছর জুড়েই উচ্চ আর্দ্রতা বিরাজমান থাকে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ স্থানে মার্চ-এপ্রিল মাসে সর্বাপেক্ষা কম আর্দ্রতা পরিলক্ষিত হয়। মার্চ মাসে দিনাজপুরে সর্বনিম্ন গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতা (৫৭%) পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাসমূহে নিম্নতম আর্দ্র মাসগুলি হচ্ছে জানুয়ারি থেকে মার্চ। এ এলাকায় সর্বনিম্ন মাসিক আর্দ্রতা রেকর্ড করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মার্চ মাসে (৫৮.৫%)। জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে দেশের সর্বত্র আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০%-এর অধিক থাকে। জুলাই অথবা আগস্ট মাসে সম্পৃক্তি ঘাটতি (saturation deficit) সবচেয়ে কম হয়ে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে আর্দ্রতা চরমে পৌঁছে, এসময় বৃষ্টিপূর্ণ দিনের সংখ্যাও খুব বেশি হয় না। ভ্যাপসা গরম আবহাওয়ায় মানুষ অতীষ্ট হয়ে ওঠে। বার্ষিক গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিসীমাটি হল কক্সবাজারে সর্বোচ্চ ৭৮.১% থেকে পাবনায় সবনিম্ন ৭০.৫% পর্যন্ত।

মেঘ  বাংলাদেশে মেঘাচ্ছন্নতার ধরন দুই বিপরীত ঋতু শীত ও গ্রীষ্মে বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। শীতকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত শুষ্ক ও শীতল বায়ুপ্রবাহের ফলে মেঘাচ্ছন্নতা থাকে সর্বনিম্ন। এ মৌসুমে সমগ্রদেশে গড়ে প্রায় ১০% মেঘাচ্ছন্নতা দেখা যায়। শীতঋতু অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে মেঘের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং প্রাক-বর্ষা গ্রীষ্মকালের শেষ পর্যায়ে এ মাত্রা ৫০% থেকে ৬০%-এ পৌঁছায়। বর্ষাকালে মেঘাচ্ছন্নতার মাত্রা খুবই ব্যাপক হয়। বর্ষাঋতুর মাঝামাঝিতে জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশের সর্বত্র ৭৫% থেকে ৯০% মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বিদ্যমান থাকে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭৫% মেঘাচ্ছন্ন আকাশের তুলনায় দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলীয় অংশে মেঘাচ্ছন্নতার মাত্রা থাকে বেশি তথা ৯০%। বর্ষাকাল শেষে মেঘাচ্ছন্নতা দ্রুত হ্রাস পায়। উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে এর মাত্রা ২৫% এবং দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে এর মাত্রা দাঁড়ায় ৪০-৫০%-এ।

বৃষ্টিপাত  বাংলাদেশের জলবায়ুতে সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তার করে বৃষ্টিপাত। ক্রান্তীয় মৌসুমি অঞ্চলে অবস্থানের কারণে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত চক্রের ঋতুগত পার্থক্য অতি সুস্পষ্ট এবং তা তাপমাত্রার ঋতুগত চক্রের তুলনায় অধিকতর সুনির্দিষ্ট। শীতকাল বৃষ্টিহীন ঋতু এবং ডিসেম্বর শুষ্কতম মাস। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আগত জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুর প্রভাবে কিছু বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের মাত্র ২-৪% এ সময়ে ঘটে থাকে। দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে শীতকালীন বৃষ্টিপাত ২০ মিমি-এরও কম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তা ৪০ মিমি-এর কিছু বেশি হয়ে থাকে। উত্তর-পূর্বাংশে অতিরিক্ত কিছু আর্দ্র বায়ু মেঘালয় মালভূমিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়ার প্রভাবে ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে মেঘের সৃষ্টি করে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এ অঞ্চলে সামান্য বেশি হয়ে থাকে। শীতকাল পার হয়ে প্রাক-মৌসুমী গ্রীষ্মঋতুর আগমন ঘটতে থাকলে ভূ-পৃষ্ঠের প্রচন্ড উত্তাপ এবং বঙ্গোপসাগর থেকে আসা প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের ১০-২৫% এ ঋতুতে সংঘটিত হয়ে থাকে যা বজ্রবিদ্যুৎসহ ধ্বংসাত্মক কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে সংঘটিত হয়ে থাকে।

অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমবেশি হয়ে থাকে। পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ মিমি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তা ৮০০ মিমি-এর সামান্য বেশি হয়ে থাকে। শীতঋতুর মতোই অতিরিক্ত আর্দ্রবায়ু মেঘালয় মালভূমিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়ার প্রভাব এ অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণ। বঙ্গোপসাগর থেকে আগত গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপসমূহ বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে। দেশের পূর্বাঞ্চলে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের শতকরা ৭০ ভাগ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শতকরা ৮০ ভাগ এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শতকরা ৮৫ ভাগের সামান্য বেশি বর্ষাকালেই সংঘটিত হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১০০০ মিমি থেকে শুরু করে দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০০ মিমি-এর অধিক হয়ে থাকে। গড় বাদলা দিনের সংখ্যা অঞ্চলভেদে কম বেশি হয় এবং দেশের পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ৬০ দিন, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৯৫ দিন এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১০০ দিনেরও বেশি বর্ষাকালে বাদলমুখর থাকে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ভৌগোলিক বণ্টনের আঞ্চলিক ভিন্নতার ক্ষেত্রে দেশের পশ্চিম-কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১৫০০ মিমি বৃষ্টিপাত থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অংশে ৪০০০ মিমি-এরও অধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। সিলেট জেলার উত্তরাংশে এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে বিশেষ করে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়া কেন্দ্রসমূহ  বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানের আবহাওয়া ও জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, উপাত্ত সংগ্রহ, নথিবদ্ধকরণ এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের প্রধান প্রধান আবহাওয়া কেন্দ্রসমূহ যেখান থেকে জলবায়ু সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি উপাত্ত পাওয়া যায় সেগুলি হল: বরিশাল, ভোলা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ঢাকা, দিনাজপুর, ফরিদপুর, ফেনী, হাতিয়া, ঈশ্বরদী, যশোর, খেপুপাড়া, খুলনা, কুতুবদিয়া, মাদারীপুর, মাইজদী কোর্ট, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, রাজশাহী, রাঙ্গামাটি, রংপুর, সৈয়দপুর, সন্দ্বীপ, সীতাকুন্ড, শ্রীমঙ্গল, সিলেট এবং টেকনাফ।

আবহাওয়া প্রতিবেদন  একটি নির্দিষ্ট সময়জুড়ে একটি নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া সম্পর্কিত বর্ণনা, চার্ট ও মানচিত্রসহ বিস্তারিত তথ্যমূলক প্রতিবেদন। প্রস্ত্ততকৃত আবহাওয়া প্রতিবেদনসমূহের ভিত্তি হচ্ছে প্রধান প্রধান জলবায়ু কেন্দ্রসমূহে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রসমূহ প্রেরিত উপাত্ত। এসকল প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের আবহাওয়া প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। এ অধিদপ্তরের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, আবহাওয়া কেন্দ্রসমূহ তত্ত্বাবধান, আবহাওয়া যন্ত্রপাতির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং জনসাধারণকে নিয়মিত দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা। উপরিউল্লিখিত ২৯টি প্রধান আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন দেশের সকল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত ঢাকায় অবস্থিত আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রেরণ করা হয় এবং এখানে প্রেরিত উপাত্তসমূহের বিশ্লেষণ, মানচিত্র তৈরি ও বর্ণনামূলক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসকল উপাত্তের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, উচ্চতর বায়ুস্তর পর্যবেক্ষণ এবং ঢাকায় সংগৃহীত উপগ্রহ চিত্র ও রাডার চিত্র সহযোগে আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। উপগ্রহ এবং রাডার চিত্রগুলির পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস প্রদানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ৬ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা ও ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া বার্তা ও পূর্বাভাস প্রচার করা হয়। আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং পূর্বাভাস প্রদানের পাশাপাশি বেতার ও টেলিভিশনে অবিরাম জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়ে থাকে। বেতার ও টেলিভিশন ছাড়াও দৈনিক সংবাদপত্রগুলি আবহাওয়া বিভাগের সরবরাহকৃত আবহাওয়া বার্তা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে থাকে।

পর্যবেক্ষণকৃত আবহাওয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়াবলীর তথ্যাদির প্রতিদিনকার মাত্রা সমন্বয়ে জলবায়ুগত উপাত্ত সংগৃহীত হয়। নিম্নলিখিত বিষয়াবলীর মাসিক মাত্রা অন্তর্ভুক্ত থাকে (১) গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, (২) গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা (৩) গড় মাসিক তাপমাত্রা (৪) গড় শিশিরপাত, (৫) গড় বায়ুচাপ (৬) গড় বায়ুপ্রবাহের দিক (৭) বাতাসের গড় গতিবেগ (৮) গড় মেঘাচ্ছন্নতা এবং (৯) সর্বমোট বৃষ্টিপাত। এসকল তথ্যাদি ঢাকার আগারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে নথিভুক্ত থাকে এবং এখানে এ সংক্রান্ত তথ্য সহজ প্রাপ্য।

জলবায়ুগত পরিবর্তন  বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সাধারণভাবে বলা হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) পরিমাণ বৃদ্ধিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। তবে সকল বিজ্ঞানী বিশ্ব উষ্ণায়নের এ তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন।

কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি একই সঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে- কোনো কোনো অঞ্চলের জন্য তা হবে ধ্বংসাত্মক, আবার অন্যান্য অঞ্চলের জন্য তা উপকারী হয়ে দেখা দেবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন মেরু অঞ্চল এবং হিমালয়ের চূড়ায় বিদ্যমান বরফস্তরকে ধীর ধীরে গলিয়ে ফেলবে। এর ফলে, এক হিসাব মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২ থেকে ৩ মিটার বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর সকল উপকুলীয় সমভূমি এবং বদ্বীপ অঞ্চলসমূহ জলমগ্ন হয়ে পড়বে এবং সেইসঙ্গে উর্বর কৃষিভূমি ও খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতি, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি পাবে। যদি এ আশঙ্কা বা ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়ে দেখা দেয়, তাহলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক এলাকা বঙ্গোপসাগরের নিচে তলিয়ে যাবে। অবশ্য এ তত্ত্বের বিপরীত তত্ত্বও রয়েছে।  [রফিক আহমেদ]

গ্রন্থপঞ্জি  রফিক আহমেদ, আবহাওয়া ও জলবায়ু বিজ্ঞান; RG Barry and RJ Chorley, Atmosphere, Weather and Climate, Routledge, London and New York, 1988; Rafique Ahmed and S Karmakar, ‘Arrival and withdrawal dates of the summer monsoon in Bangladesh’, International Journal of Climatology, 13:7, 1993.