ছায়ানট

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:৫৩, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

ছায়ানট  একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংস্কৃতিচর্চায় দেশিয় ঐতিহ্য ও প্রকৃতিমুখী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানি শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে কিছু বাঙালি একত্র হয়েছিলেন নিজেদের সংস্কৃতির প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষপূর্তির উৎসব করার জন্যে। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানি যুগে কঠোর সামরিক শাসনে পদানত স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। বিশ্বে শতবার্ষিকীর আয়োজন বাংলার এ প্রান্তের সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের মনেও চাঞ্চল্য জাগায়। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ বুদ্ধিজীবী যেমন উদ্যোগী হলেন-তেমনি ঢাকার কিছু সংস্কৃতিকর্মীও এগিয়ে আসেন শতবর্ষ উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে। সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় রবীন্দ্রশতবার্ষিকীর সফল উদ্যোগ। পরে সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), সায়েরা আহমদ, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকর ‘ভীমরুল’), ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান (ছানা), সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ বহু অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার লক্ষ্যে একটি সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। ছায়ানট সে উদ্যোগের ফল।

সঙ্গীতকে অবলম্বন করেই বাঙালির সংস্কৃতি সাধনার সমগ্রতাকে বরণ ও বিকশিত করতে উদ্যোগী হয় ছায়ানট। সঙ্গীত শিক্ষাদান কার্যক্রমের সুবাদে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কীর্তিমান গুণী শিল্পীরা সমবেত হন ছায়ানটে; পর্যায়ক্রমে তাঁরা বিকশিত করতে থাকেন অগণিত নবীন প্রতিভা। বাঙালির শাশ্বত সংস্কৃতিরূপ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে ছায়ানট পরিবেশিত অনুষ্ঠানমালা জাতির প্রাণে জাগায় নতুন উদ্দীপনা, সঙ্গীত-সংস্কৃতির চর্চাসূত্রে জাতিসত্তার চেতনা বলবান হতে থাকে। ছায়ানটের উদ্যোগে জাতির শৈল্পিক ও মননশীল মেধার সম্মিলন ও অনুশীলন জাতিকে যোগায় বিকাশের বিবিধ অবলম্বন।

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান


চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধনে পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা। ছায়ানট প্রতিষ্ঠার পরই বাঙালিকে তার গানের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিতে ঘরোয়া পরিবেশে আয়োজন করে সুরুচিসম্মত সঙ্গীত অনুষ্ঠান ‘শ্রোতার আসর’। ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠানের মধ্যে- রমনা বটমূলে বর্ষবরণ, জাতীয় দিবস (শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস), রবীন্দ্র-নজরুল জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী, ঋতু উৎসব (বর্ষা, শরৎ, বসন্ত), লোকসঙ্গীতের উৎসব, নাট্যেৎসব  দেশঘরের গান, শুদ্ধসঙ্গীত উৎসব, রবীন্দ্র-উৎসব, নজরুল-উৎসব, নৃত্যোৎসব এবং মাসিক নির্ধারিত বক্তৃতামালা।

স্বাধীনতার পূর্বে বাংলা একাডেমী, ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুল (বর্তমান উদয়ন বিদ্যালয়ের পুরাতন অস্থায়ী গৃহ), আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন (বর্তমান অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়) এবং কলাবাগানের লেক সার্কাস হাই স্কুলে স্থানান্তরিত হয়ে কাজ চালিয়ে এসছে ছায়ানট। স্বাধীনতা উত্তর তিন দশকের জন্য ঠাঁই পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল ভবনে। ছায়ানটের সাড়ে চার দশকের সংস্কৃতি-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিষ্ঠানকে স্বীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৯৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এক বিঘা জমি বরাদ্দ দেন ধানমন্ডিতে। এ জমিতে নির্মিত ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপকতর অবদান রাখার লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের নক্শা প্রণয়ন করেছেন প্রখ্যাত স্থপতি বশিরুল হক। কেবল সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় বরং দেশের সংস্কৃতি কর্মকান্ডের সহায়ক কেন্দ্র হিসেবে রূপ নিচ্ছে ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন। ভবনের নিয়মিত কর্মকান্ডের মধ্যে সঙ্গীতবিদ্যায়তন, সংস্কৃতি-সমন্বিত সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয় ‘নালন্দা’, শিশুদের মনন বিকাশের কার্যক্রম ‘শিকড়’, অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের সহায়ক কর্মকান্ড ‘সুরের জাদু রঙের জাদু’, বাংলা ভাষা-সাহিত্য চর্চার জন্য ‘ভাষার আলাপ’ কার্যক্রম, গানের মাসিক অনুষ্ঠান ‘শ্রোতার আসর’ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা বাংলাদেশের হূদয় হতে ছাড়াও রয়েছে দেশ-জাতি-সংস্কৃতি বিষয়ের নানা শিক্ষা কার্যক্রম। ভবনে ৩০টি শ্রেণিকক্ষের বাইরেও রয়েছে ‘রমেশচন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনকেন্দ্র’, সঙ্গীত-সংস্কৃতিবিষয়ক গ্রন্থাগার ‘কবি শামসুর রাহমান পাঠাগার’, শ্রবণ-দর্শন কেন্দ্র ও রেকর্ডিং স্টুডিও সম্বলিত ‘সংস্কৃতি-সম্ভার’ এবং আধুনিক সুবিধাদিসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ৩০০ আসন-বিশিষ্ট মিলনায়তন। ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নে। স্বাধীনতা-পরবর্তী দু-বছর যৎসামান্য অনুদান ছাড়া ছায়ানট কখনও সরকারি সহায়তা নেয়নি। ছায়ানটের শিক্ষকমন্ডলীর অনেকে কাজ করেন বেতন-ভাতা ব্যতিরেকে বা সামান্য সম্মাননার বিনিময়ে। অনুষ্ঠান নিবেদন বাবদ শিল্পী বা কর্মীদের কেউ কোনো আর্থিক সম্মানী গ্রহণ করেন না। শিক্ষক, শিল্পী, কর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের এরকম বহু অবদান মিলে ছায়ানটের অর্থ-সঞ্চয়। প্রাথমিক ব্যয় ৫.১  কোটি টাকার মধ্যে ছায়ানটের সঞ্চিত ১ কোটি টাকা দিয়েই নির্মাণ কাজ সূচিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদান এবং ব্যক্তিগত দানের আরও ২ কোটি টাকা। নির্মাণকালীন ৪ বছরে সঙ্গীতবিদ্যায়তনের শিক্ষার্থীদের চাঁদা ও অনুদানে যোগ হয়েছে আরও প্রায় ১ কোটি টাকা। শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-চারুশিল্পী-চিত্রকরসহ আপামর জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতাতেই গড়ে উঠেছে এ সংস্কৃতি-ভবন।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ছায়ানটের কার্যক্রমের অন্যতম একটি। কাজটি ছায়ানটের দায় এবং ঐতিহ্যগত। ষাটের দশকের শুরুতে দেশের দক্ষিণোপকূলে গোর্কি আঘাত হানার পর কোনো সরকারি সাহায্য ছাড়া উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যায় ছায়ানট। তাদের সংগৃহীত অর্থের অনেকাংশ দুর্যোগকালের আশ্রয়স্থল ও দুটি বিদ্যালয় ভবন উন্নয়নের কাজে ব্যয় হয়। তাছাড়া ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাস ও উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এবং পরবর্তীকালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত বিপন্ন মানুষদের পাশে ছিল এ সংগঠন।

সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির পথপরিক্রমণের গৌরবের অংশ ছায়ানট। স্বাধীনতার পর সংস্কৃতি ও সঙ্গীতচর্চাকে আরও ব্যাপক ও নিবিড় করে তোলার সৃষ্টিশীল সাধনায় নিমগ্ন রয়েছে ছায়ানট। দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতির নবজাগরণের লক্ষ্যে গান, নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ ও প্রসারে নিয়োজিত রয়েছে। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক বিকৃতি ও সংস্কৃতিহীনতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ছায়ানট বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ভাষা, সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, কারুশিল্প, নৃত্যসহ শিল্পকলার যাবতীয় ক্ষেত্রে এবং সংস্কৃতিচর্চার ভিত্তি হিসেবে যথাযথ সাধারণ শিক্ষায় ছায়ানটের কার্যক্রম প্রসারিত হয়ে চলবে বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

[মোহাম্মদ আবদুল হাই]