চ্যুতি

চ্যুতি (fault)  শিলার মধ্যে একটি ফাটল যার দৈর্ঘ্য বরাবর দৃশ্যমান স্থানচ্যুতি ঘটে। প্রথানুযায়ী একটি চ্যুতি বর্ণনা করতে চ্যুতিটির সহিত বেডিং স্ট্রাইক ও চ্যুতি স্ট্রাইকের সম্পর্ক জানা প্রয়োজন। চ্যুতি স্ট্রাইকটি যদি বেডিং স্ট্রাইকের সাথে সমান্তরাল বা প্রায় সমান্তরাল হয় তাহলে স্ট্রাইক চ্যুতির সৃষ্টি করে। আবার চ্যুতি স্ট্রাইকটি যদি বেডিং স্ট্রাইকের সাথে প্রায় লম্বভাবে অবস্থান করে তবে ডিপ চ্যুতির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে চ্যুতি স্ট্রাইকটি যদি বেডিং স্ট্রাইকটির সহিত একটি পরিষ্কার কোনোকোনি সম্পর্কে অবস্থান করে তাহলে একটি তির্ষক চ্যুতির সৃষ্টি হয়। একটি ডিপিং চ্যুতিতে চ্যুতিতল বরাবর শিলাক্ষেত্রের উপরে অবস্থানকারী শিলাকে ঝুলন্ত দেওয়াল (hanging wall) বলে। অনুরূপে একটি ডিপিং চ্যুতিতে চ্যুতিতল বরাবর শিলাক্ষেত্রের নিচে অবস্থানকারী শিলাকে ফুটওয়াল (footwall) বলে। বাংলাদেশে বিরাজমান প্রধান প্রধান চ্যুতিসমূহের একটি বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:

চিত্র-১. (ক) প্রধান চ্যুতিসমূহ; (খ) ডান ও বাম স্ট্রাইক স্লিপ চ্যুতি

নরমাল চ্যুতি (normal fault) এ ধরনের চ্যুতিতে ঝুলন্ত দেওয়ালটি চ্যুতিতলের নিম্ন দিকে থাকে (চিত্র-১)। নরমাল চ্যুতিকে কোনো কোনো সময় পীড়ন চ্যুতি বা অভিকর্ষ চ্যুতিও বলা হয়ে থাকে। নরমাল চ্যুতির দ্বারা ভূত্বকের খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হওয়াকে ব্লক চ্যুতি বলে। এভাবে সারিবদ্ধ সমান্তরাল চ্যুতির ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী খন্ডসমূহ একইদিকে বিচ্যুত হলে ধারা চ্যুতির (step fault) সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে বগুড়া চ্যুতিকে নরমাল চ্যুতি বলা হয়। এ চ্যুতি ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় ছিল এবং বর্তমানে এটি পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপান অঞ্চলে (western foreland shelf) অবস্থিত। বগুড়া চ্যুতি বরাবর বিচলনের ফলে বগুড়া গ্রাবেন অঞ্চলে বিশাল পাললিক শিলাস্তরের সৃষ্টি হয়েছে। ভূকম্পীয় তথ্যাদি এবং বিশেষ করে বগুড়া-x1 ও কুচমা-x1 কূপসমূহের জীবস্তরতত্ত্ব বিদ্যা গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে বগুড়া চ্যুতি প্যালিওজিন ও নিওজিন সময়ে অধিকতর সক্রিয় ছিল। বগুড়া চ্যুতির নিম্নমুখী খন্ডটিতে অর্থাৎ বগুড়া গ্রাবেনে ঊর্ধ্বমুখী খন্ডটি অপেক্ষা অধিক পরিমাণে সিলেট চুনাপাথর অবক্ষেপিত হয়েছিল। এটি চ্যুতি বরাবর খাড়া বিচলন এবং বগুড়া গ্রাবেন এলাকায় সিলেট চুনাপাথর জমা হওয়ার সময় ভূঅবনমন নির্দেশ করে। উপরন্তু বগুড়া গ্রাবেন এলাকায় অধিকতর পুরু নবীন মায়োসিন অবক্ষেপ নির্দেশ করে যে বগুড়া চ্যুতি মধ্য ও নবীন মায়োসিন সময়ে সক্রিয় ছিল।

শিলং মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ডাওকি চ্যুতি বলয়ের (চিত্র-৩) সাথে ব্লক চ্যুতি বেষ্টিত উত্তরাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপান এলাকার এবং ব্লক চ্যুতি পূর্ণ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্লায়ো-প্লাইসটোসিন পিডমন্ট অপক্ষেপসমূহকে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত একটি আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ গাঠনিক একক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। হিঞ্জ বলয় অঞ্চলটিকে ভূত্বকের গভীরে অবস্থিত ভিত্তিশিলার মধ্যস্থিত নরমাল চ্যুতি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মূলত এটি ভারতীয় প্লাটফর্ম ও বঙ্গীয় ফোরডীপকে দুভাগে বিভক্ত করে। হিঞ্জ বলয়টির দৈর্ঘ্য বরাবর সারিবদ্ধ ধাপ চ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। এ বলয়টি ভূকম্পীয়ভাবে সক্রিয় এবং ভূমিকম্পনের কেন্দ্রটি সম্ভবত এ বয়লটির ৭১ থেকে ১৫০ কিমি গভীরে সৃষ্টি হয়েছে।

ঠেলাচ্যুতি (thrust fault)  এ ধরনের চ্যুতিতে ঝুলন্ত দেওয়ালটি (hanging wall) ফুটওয়ালের সাপেক্ষে চ্যুতিতলের ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। এ রকমের চ্যুতি পৃথিবীর ঠেলা ভাঁজ অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয়। সাধারণভাবে বাংলাদেশের ঠেলাচ্যুতিসমূহ পূর্বাঞ্চলীয় ভাঁজ অঞ্চলসমূহের ঊর্ধ্বভঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত। ভারতীয় প্লেটের মায়ানমার প্লেটের ভিতর অধোগমনের কারণে চট্টগ্রাম-ত্রিপুরার পূর্বাঞ্চলীয় ভাঁজ অঞ্চল অথবা সম্মুখস্থ ভাঁজ অঞ্চলের (frontal folded belt) ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণী একটি ঠেলা ভাঁজ অঞ্চল গঠন করেছে। ঠেলা ভাঁজ অঞ্চলের প্রধান ঊর্ধ্বভাঁজগুলির একটি বাহু অথবা উভয় বাহুই ঠেলাচ্যুতি দ্বারা সংসর্গীকৃত। ঠেলাচ্যুতিগুলি পূর্বদিকে ডিপ বিশিষ্ট। চট্টগ্রাম ভাঁজ অঞ্চলের প্রধান প্রধান ঊর্ধ্বভাঁজগুলি যেমন সীতাকুন্ড ঊর্ধ্বভাঁজ, সীতাপাহাড় ঊর্ধ্বভাঁজ, বান্দরবান ঊর্ধ্বভাঁজ, গোবামুরা ঊর্ধ্বভাঁজ, মাতামুহুরী ঊর্ধ্বভাঁজ, দক্ষিণ নীলা ঊর্ধ্বভাঁজ, উথানছতরা ঊর্ধ্বভঙ্গের পশ্চিম বাহুসমূহ পূর্ব ডিপিং বিশিষ্ট ঠেলাচ্যুতি দ্বারা আবৃত। এসব ঊর্ধ্বভঙ্গের কোনো কোনোটির পূর্ববাহু আবার পশ্চিম ডিপিং ঠেলাচ্যুতি দ্বারাও আবৃত। ঠেলাচ্যুতির তীব্রতা পূর্বদিকে বৃদ্ধি পায় এবং পশ্চিমদিকে কমে যায়। যেহেতু ভাঁজ অঞ্চলের পশ্চিম পার্শ্বে ভাঁজের তীব্রতা হ্রাস পায় সেহেতু এ অঞ্চলে বড় ধরনের ঠেলাচ্যুতি দেখা যায় না। আরও পশ্চিমে যেখানে ভাঁজ অঞ্চলসমূহ ফোরডীপের সাথে মিশে যায় সেখানে সাধারণ, অজটিল ও চ্যুতি বর্জিত ঊর্ধ্বভাঁজসমূহ পরিলক্ষিত হয়।

ঠেলাচ্যুতি ঊর্ধ্বভাঁজসমূহের স্ট্রাইকের অনুরূপ উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিস্তৃত। উপগ্রহ তথ্য মারফত অথবা নদীসমূহের হঠাৎ অবক্রগতির লক্ষণসমূহ দেখে ভাঁজ অঞ্চলের ভিতর কিছু আড়াআড়ি চ্যুতির আলামত পাওয়া যায়। এ আড়াআড়ি চ্যুতিগুলি ঊর্ধ্বভাঁজসমূহের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত কেটে গেছে।

চট্টগ্রাম ভাঁজ অঞ্চলে ঠেলাচ্যুতিসমূহ ভূসংস্থান এবং স্তরতত্ত্ব এককের বিন্যাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ঊর্ধ্বভাঁজসমূহের পশ্চিম বাহুর খাড়া উচ্চতা ঠেলাচ্যুতির কারণেই হয়ে থাকে। এটি নবীন শিলাস্তরসমূহকে প্রবীন শিলাস্তরসমূহের পাশাপাশি অবস্থানে নিয়ে আসে। যেমন টিপাম শিলাস্তর ও ভূবন শিলাস্তরের পাশাপাশি অবস্থান নেওয়া।

স্ট্রাইক স্লিপ চ্যুতি  (strike-slip fault) এটির বৈশিষ্ট্য হলো স্থানচ্যুতি সাধারণত চ্যুতির স্টাইকের সমান্তরাল হয়ে থাকে। এ ধরনের চ্যুতি খাড়া ও সোজা, চ্যুতির আশপাশে চাপের ফলে ভগ্ন বা চূর্ণ শিলাখন্ডসমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এবং বড় ধরনের স্ট্রাইক স্লিপচ্যুতি একটি চ্যুতি বলয়ের সৃষ্টি করে। একটি স্ট্রাইক স্লিপ চ্যুতির সম্মুখভাগে দাঁড়ালে যদি উল্টাপাশের শিলাখন্ডের স্থানচ্যুতি ডানদিকে হয়, তবে এটিকে ডানহাতি চ্যুতি বলা হয়ে থাকে। একইভাবে যদি স্থানচ্যুতি বামদিকে হয় তবে এটিকে বামহাতি চ্যুতি বলা হয় (চিত্র-১)। টিয়ার চ্যুতিতে সাধারণত আনুভূমিক বিচলন ঘটে থাকে। এ ধরনের চ্যুতিতে দৃষ্টিগোচর বিচলন বুঝানোর জন্য ডানহাতি বা বামহাতি পরিভাষাসমূহ ব্যবহার করা হয়। এ রকমের চ্যুতির মধ্যে কালাদান চ্যুতি প্রায় ২৭০ কিমি লম্বা এবং এটি মিজোরাম-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম ভাঁজ বলয়ের পূর্ব সীমানা নির্দেশ করে। চ্যুতিটি উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আরাকান উপকূলের কালাদান নদী বরাবর বাঁক নিয়েছে। কালাদান চ্যুতিকে ডানহাতি ট্রান্সফর্মড চ্যুতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

চিত্র-২. মধুপুরগড়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ চ্যুতির চিহ্নসমূহ। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবনভূমির দিকে ৯ মিটার চ্যুতি নিক্ষেপ দেখানো হয়েছে।

হরস্ট এবং গ্রাবেন  (horst and graben) কিছু চ্যুতিখন্ড তাদের উভয়দিকে অভিকর্ষ চ্যুতি দ্বারা প্রভাবিত থাকে এবং এ অভিকর্ষ চ্যুতি বরাবর বিচলন কমবেশি একই রকম হয়। গ্রাবেন খন্ডটি তার প্রস্থের চাইতে দৈর্ঘ্যে লম্বা এবং তার দুইপাশের খন্ডের চাইতে অবনত থাকে। অনুরূপে হরস্ট খন্ডটিও তার প্রস্থের চাইতে দৈর্ঘ্যে লম্বা তবে তার দুইপাশের খন্ডের চাইতে উন্নত থাকে। প্লাইসটোসিন সময়ের শেষের দিকে বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চল উন্নত ছিল এবং পরবর্তীতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবনভূমির সক্রিয় গ্রাবেন দ্বারা এরা পৃথক হয়েছিল (চিত্র-২)। অন্যদিকে বগুড়া গ্রাবেন পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপান অঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি ভূ-অভ্যন্তরে গন্ডোয়ানা সিস্টেমের কয়লা সমেত পাললিক শিলার অবক্ষেপ দ্বারা গঠিত। প্রস্থচ্ছেদে এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে দক্ষিণ-পূর্বগামী খাড়া প্রধান সীমানা চ্যুতি (main boundary fault) অবস্থিত। বস্ত্তত বগুড়া চ্যুতির নিম্নমুখী ঠেলা খন্ড হলো বগুড়া গ্রাবেন। বগুড়া চ্যুতির ঊর্ধ্বমুখী ঠেলা খন্ডের চাইতে এ গ্রাবেনটিতে সিলেট চুনাপাথরের পুরুত্ব অনেক বেশি।

এন-এশিলন চ্যুতি (en-echelon fault)  অনেক সময় অভিকর্ষজনিত চ্যুতি এন-এশিলন নমুনা দেখায় যেখানে পৃথক পৃথক চ্যুতির স্ট্রাইকসমূহ চ্যুতি বলয়ের সহিত ৪৫° কোণ তৈরি করে। মধুপুর গড়ের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে রয়েছে নব এন-এশিলন চ্যুতিসমূহ। এগুলি সাম্প্রতিক সময়ের ভূ-গাঠনিক রূপরেখার চিহ্নবহন করে। উপরন্তু মধুপুর গড়ের অভ্যন্তরভাগ ও এর সন্নিহিত এলাকার ভূকম্পন (একটি ভূমিকম্পনের কেন্দ্র ফুটগঞ্জ-তুরাগ উপত্যকার সন্নিহিত অঞ্চল), এন-এশিলন চ্যুতির বিচলনের ফলে মধুপুর গড়ের উত্থানের ইঙ্গিত বহন করে। সম্ভবত এ বিচলন এখনও অব্যাহত রয়েছে।

পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত ডাওকি চ্যুতি হলো শিলং মালভূমির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ডাওকি চ্যুতি শিলং মালভূমির দক্ষিণ সীমানা নির্দেশ করে। এ চ্যুতি বলয় মালভূমিটির দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে একটি খাড়া ঢালের সৃষ্টি করেছে। এ খাড়া ঢালটি বাংলাদেশের সমতলভূমির সক্রিয় ভূ-অবনমনের সাপেক্ষে ডাওকি চ্যুতি বলয়ের উল্লম্ব বিচলন নির্দেশ করে। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রে (১৯৯০) ডাওকি চ্যুতি বলয়কে একটি একক চ্যুতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক উপগ্রহ ছবিতে এ চ্যুতি বলয়কে একাধিক এন-এশিলন চ্যুতির সমন্বয় হিসেবে দেখানো যায়, যাদের প্রবণতা উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী। ফলে ডাওকি চ্যুতির প্রবণতা সোজা হওয়ার পরিবর্তে অনেকটা অাঁকাবাঁকা মনে হয়।

গ্রোথ চ্যুতি (growth fault)  এ ধরনের চ্যুতি খুব বেশি পরিমাণ পলল অবক্ষেপ এলাকায় দেখা যায়। সাধারণত এ চ্যুতিসমূহ পুরু বদ্বীপিয় পরিবেশের সাথে জড়িত। তুলনামূলকভাবে চ্যুতিগুলি আকারে ছোট হয়ে থাকে যেমন প্রস্থে ১৫-২০ কিমি ও দৈর্ঘ্যে ৪৫-৫০ কিমি। এগুলি গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উত্তোলন ও উন্নয়ন ক্ষেত্র। বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী ক্রান্তীয় অঞ্চলের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের বদ্বীপিয় ফ্রন্ট এলাকার ভূকম্পনীয় জরিপ তথায় ধপ করে পতিত হওয়া অবক্ষেপের (slump) সন্ধান দেয়। সম্ভবত গ্রোথ চ্যুতির সাথে এ সোয়াম্প অবক্ষেপগুলি জড়িত। সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলায় বাপেক্স গ্রোথ চ্যুতির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছে।

চিত্র-৩. উইন্ডো-১ এ ভাঁজ অক্ষের দক্ষিণমুখী বাঁক দেখানো হয়েছে। এটি শিলং মালভূমির উত্তথথেকে দক্ষিণ দিকের ধাক্কা নির্দেশ করে। উইন্ডো-২ এ ভাঁজ অক্ষ পূর্ব-পশ্চিমমুখী। এটি উত্তর-দক্ষিণমুখী কমপ্রেসনাল বল এই অঞ্চলের প্লায়োপ্লাইসটোসিন ভাঁজ সৃষ্টির কারণ নির্দেশ করে।

প্রধান ভূ-গাঠনিক রূপরেখা  বাংলাদেশ ক্রিটেসিয়াস থেকে হলোসিন সময়ের বঙ্গীয় অববাহিকার (Bengal Basin) একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং এটি ভারতীয় ও বর্মীয় প্লেটের সংযোগস্থলে পৃথিবীর একটি সক্রিয় ভূ-গাঠনিক অঞ্চলে অবস্থিত। বঙ্গীয় অববাহিকাকে ভূ-গাঠনিকভাবে দুটি প্রধান এককে ভাগ করা যায়: (১) পশ্চিমাঞ্চলীয় ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারতীয় বর্মাঞ্চলের (Craton) আলতো ঢাল বিশিষ্ট সুস্থিত সোপান এবং (২) পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বেঙ্গল ফোরডীপের গভীর অববাহিকীয় অঞ্চল। হিঞ্জ বলয় এলাকাটি এ দুটি ভূ-গাঠনিক একককে বিভক্ত করে।

উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত হিঞ্জ বলয়টি যার প্রস্থ ২৫-৩০ কিমি কলকাতা-পাবনা-ময়মনসিংহ অভিকর্ষীয় উচ্চ এলাকা (gravity high) এবং আরও উত্তর-পূর্বে ডাওকি চ্যুতি ও আসামের নাগা পাহাড় অঞ্চল অতিক্রম করে। হিঞ্জ বলয়টি উত্তর-পূর্ব ভারতের নবীন মেসোজয়িক উপকূলের নির্দেশক। বঙ্গীয় অববাহিকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে ভিত্তিশিলার ঢাল আলতোভাবে দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখী হয়েছে। এভাবে অববাহিকাটির পশ্চিমাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপানের সৃষ্টি হয়েছে। সোপানটির গভীরতা হিঞ্জ বলয় বরাবর ১০ কিলোমিটারের বেশি এবং এটিতে পাললিক অবক্ষেপের পুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গীয় অববাহিকার উত্তরে রংপুর স্যাডেল অঞ্চলে ভিত্তিশিলার গভীরতা খুবই কম। দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় ভিত্তিশিলার গভীরতা মাত্র ১৫০ মিটার। এটি পূর্বাঞ্চলে শিলং মালভূমি পর্যন্ত ভারতীয় শিল্ডের ভূগর্ভস্থ স্তর নির্দেশ করে।

সম্প্রসারিত উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত বরিশাল-চাঁদপুর অভিকর্ষীয় উচ্চ এলাকাটি ভিত্তিশিলা নিয়ন্ত্রিত চ্যুতি বলয় অঞ্চল। এ অভিকর্ষীয় উচ্চ এলাকাটি গন্ডোয়ানাল্যান্ড ভেঙ্গে যাওয়ার প্রথমদিকে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ভিতর দিয়ে সৃষ্ট ভারতীয় পূর্ব উপকূলের উত্তরপূর্ব বিস্তৃত স্থলভাগের বাঁক নির্দেশ করে। উপগ্রহ তথ্যসমূহ বরিশাল-চাঁদপুর অভিকর্ষীয় উচ্চ বরাবর ধনাত্মক চুম্বকীয় এনোমেলির মাধ্যমে ভিত্তিশিলার স্বল্প গভীরতা নির্দেশ করে।

ভূপদার্থীয় তথ্যাবলী শিলং মালভূমির দক্ষিণাংশে মনোক্লাইন ভূগঠন নির্দেশ করে। এ ভূগঠন বঙ্গীয় সমভূমির সাথে মিশে গিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় অন্তরীপ সোপানের সৃষ্টি করে। এ সোপানের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমানা পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত ৫-৬ কিমি প্রস্থ ডাওকি চ্যুতি বলয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাওকি চ্যুতি বলয়ের জন্য বঙ্গীয় অববাহিকার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত ভূকম্পীয়ভাবে অত্যন্ত সক্রিয়। বস্ত্তত শিলং মালভূমির চারপাশই ভূকম্পীয়ভাবে অত্যন্ত সক্রিয়।

পশ্চিমে হিঞ্জ বলয় অঞ্চল ও পূর্বে বরিশাল-চাঁদপুর অভিকর্ষীয় উচুঁ এলাকার মাঝখানে অবস্থিত বেঙ্গল ফোরডীপ একটি অভিকর্ষীয়ভাবে নিচু (low gravity) এলাকা। এটি শিলং মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ফোরডীপে দুটি খাত আছে, যেমন একটি উত্তর-পূর্বের সিলেট খাত ও অপরটি উত্তর পশ্চিমের ফরিদপুর খাত। এ দুটি খাত অঞ্চল মধুপুর গড় দ্বারা বিচ্ছিন্ন।

ভারতীয় প্লেটের মায়ানমার প্লেটের ভিতর পূর্বমুখী অধোগমনের সাথে বঙ্গীয় অববাহিকার ভিতর ২৩০ কিমি প্রশস্ত সক্রিয় গিরিজনি বলয় ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণী ঢুকে যাচ্ছে। ভারতীয় প্লেটের পূর্বমুখী অধোগমনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর ভাঁজ ও ঠেলাচ্যুতিসমূহ উত্তর-দক্ষিণমুখী হচ্ছে। ভূকম্পন তথ্যের মাধ্যমে জানা যায় যে ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর নিচে অবস্থিত ভারতীয় প্লেটের ভিত্তিশিলাসমূহ উত্তরদিকে আলোড়িত হচ্ছে। ফলে ভিত্তিশিলার উপরিস্থিত শিলাসমূহ খর্বাকৃতি হচ্ছে এবং অংশত ভিত্তিশিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

ভারতীয় ও ইউরোপীয়ান স্থলভাগের টারশিয়ারি সময়ের সংঘর্ষের নমুনাসমূহ ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর উত্তরাংশে অর্থাৎ নাগা পর্বত এলাকায় দেখা যায়। এর ফলে বরিশাল-চাঁদপুর অভিকর্ষীয় হাই ও হিঞ্জ বলয় এলাকা উক্ত অঞ্চলে পাশাপাশি এসে গেছে। ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর উত্তরাংশ, পশ্চিমমুখী হিমালয় পর্বতশ্রেণীর সাথে মিশে  একটি জটিল ভূ-গাঠনিক বলয় অর্থাৎ আসাম সিনট্যাক্সিসের সৃষ্টি করেছে।

নবীন মায়োসিন বা প্লায়োসিন সময়ে সৃষ্ট প্রধান সীমানা ঠেলাচ্যুতি (MBT) কে বর্তমান সময়ের হিমালয়ের ঠেলা ফ্রন্ট হিসেবে গণ্য করা যায়। এটি হিমালীয় ফোরডীপের উত্তরপ্রান্ত নির্দেশ করে। ফোরডীপে প্রায়ই মাঝারি থেকে উচুঁ মানের ভূকম্পন অনুভূত হয়। এম.বি.টি বলয়ে ধ্বংসাত্মক ৮ মানের ভূকম্পনও হয়েছে। হিমালয়ের পূর্বাংশে অর্থাৎ আসাম সিনট্যাক্সিয়াল বাঁকে সবচাইতে বেশি ভূকম্পন অনুভূত হয়।

বঙ্গীয় অববাহিকার পূর্বাংশে ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর পশ্চিমাঞ্চলীয় ভাঁজ বলয় অবস্থিত। এ ভাঁজ বলয়ের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল ভূকম্পীয়ভাবে সক্রিয়। এ অঞ্চলের ভূমিকম্পনসমূহ স্বল্প গভীরের আড়াআড়ি স্ট্রাইক স্লিপচ্যুতির সাথে সম্পৃক্ত। ১৭৬২ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত ৭.৫ মানের ভূমকম্পনটি সম্ভবত এ ধরনের চ্যুতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

পূর্বে ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান স্থলভাগের টারশিয়ারি সময়ের সংঘর্ষের নমুনাসমূহ ইন্দো-বার্মা পর্বতশ্রেণীর উত্তরাংশে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে সক্রিয় সামুদ্রিক অধোগমন বর্তমানে দক্ষিণে সংঘটিত হচ্ছে। এভাবে একটানা তির্যক অধোগমনের রূপরেখা সংঘর্ষ সন্ধিকে ধাপে ধাপে দক্ষিণে অগ্রসর করে গিরিজনি বলয়সহ ভূকম্পীয় কর্মকান্ডসমূহ পশ্চিমদিকে অগ্রসর হবে। ফলে ভবিষ্যতে অনেক গুপ্তচ্যুতি পুনরায় সক্রিয় হয়ে বঙ্গীয় অববাহিকার শান্ত পশ্চিম অংশকে ধীরে ধীরে ভূকম্পীয়ভাবে অশান্ত করে তুলবে।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]