চৌধুরী, নাজমা

চৌধুরী, নাজমা (১৯৪২-২০২১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ-এর সাবেক অধ্যাপক, জেন্ডার বিষয়ক গবেষণা বিশেষজ্ঞ, লেখক, ‘একুশে পদক’ প্রাপ্ত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

নাজমা চৌধুরী

নাজমা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভারতের আসাম প্রদেশের অন্তর্গত সিলেটে (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত) এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চৌধুরী ইমামুজ্জামান এবং মাতা আমিরুন্নেসা খাতুন। তাঁর পিতা ছিলেন পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং মাতা ছিলেন সুগৃহিনী। নাজমা চৌধুরীর ছিল কৃতিত্বপূর্ণ শিক্ষাজীবন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা আসাম, ঢাকা ও রাজশাহীতে। পিতার বদলিজনিত চাকরির কারনে তাঁকে শুরুতে এসব স্থানে লেখাপড়া করতে হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে মেধা তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৯ম স্থানসহ প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে যথাক্রমে ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে বি.এ (অনার্স) ও এম.এ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৭২ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ডব্লিউ. এইচ মরিস-জোনস এর তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

নাজমা চৌধুরী এক দীর্ঘ সফল বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবনের অধিকারী। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে সে জীবন শুরু এবং ২০০৭ সালে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠানিক পেশাগত শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তিনি ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন এবং ১৯৮৪-১৯৮৭ সময়ে তিনি বিভাগের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ফুলব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে ৩ মাসের জন্য আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা করেন। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। ২০০০-২০০৩ পর্যন্ত তিনি নতুন এ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দীর্ঘ ৪৫ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে ২০০৭ সালে এ বিভাগ থেকে অধ্যাপক হিসেবে তিনি অবসরে যান। ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে এ বিভাগে প্রফেসর ইমেরিটাস নিয়োগ করে।

নাজমা চৌধুরীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা রয়েছে। এর মধ্যে ঞThe Legislative Process of Bangladesh : Politics and Functioning of the East Bengal Legislature, 1947-58, (University of Dhaka 1980) এবং তিনি ও বারবারা জে. নেলসন (সম্পা.), Women and Politics Worldwide, (Yale University 1994) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় গ্রন্থটি আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞান এসোসিয়েশন কর্তৃক বছরের ‘শ্রেষ্ঠগ্রন্থ’ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। জেন্ডার বিষয়ে নাজমা চৌধুরী একাধিক মনোগ্রাম রচনা করেন।

শিক্ষাজীবনের বাইরেও, নাজমা চৌধুরী বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে দু’বার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সাধারণ পরিষদে যোগদান করেন। এছাড়া, ১৯৮৫ সালে নাইরুবি এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্বনারী সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন।

অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তাঁকে ‘রোকেয় চেয়ার’ পদে নিয়োগ দান করে। তিনি ২০০৮ সালে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

১৯৬১ সালে মাইনুল রেজা চৌধুরীর সঙ্গে নাজমা চৌধুরী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে ৭৯ বছর বয়সে নাজমা চৌধুরীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ দম্পতির ২ কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অব-রশিদ]

তথ্যসূত্র নাজমা চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা বুশরা হাসিনা চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ৩রা এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সরবরাহকৃত জীবনপঞ্জি।