চৌধুরী, রশীদ
চৌধুরী, রশীদ (১৯৩২-১৯৮৬) চিত্রশিল্পী। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার রতনদিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ‘রশীদ হোসেন চৌধুরী’ এবং ডাকনাম ‘কনক’। পিতা খানবাহাদুর ইউসুফ হোসেন চৌধুরী ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান এবং তিনি রাজনীতি ও আইন ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রবর্তিত উত্তর-উপনিবেশিক পর্বে বাংলাদেশে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও মৌলিকতায় রশীদ চৌধুরী ছিলেন সর্বজন প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব। নস্টালজিয়া ও রোম্যান্টিকতার মিশ্রণে ঐতিহ্যলব্ধ দৃশ্যপট ও বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্পূর্ণ নতুন করে তিনি নির্মাণ করেন। এতদ্সঙ্গে পাশ্চাত্যের সর্বাধুনিক টেকনিক প্রয়োগ করে একদিকে বিমূর্ত চিত্রকলা, অন্যদিকে পাট-রেশমের সমাহারে তাপিশ্রী (বুনন শিল্প) নির্মাণ তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ চিত্রকলা। জীবনের শেষ দশ বছর ইসলামি ক্যালিগ্রাফি এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রভাব তাঁর শিল্পকর্মে রূপায়িত হতে দেখা যায়।
কৈশোরে আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির বহু উপাদান, যেমন যাত্রাগান, লাঠিখেলা, মুহররমের মাতমদৃশ্য, কৃষ্ণকীর্তন, সর্পপূজা, নববর্ষ উদ্যাপন, রাজা-রানী, সাহেব-মেম ও সোনাভানুর পালা রশীদকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। এগুলির রহস্যময়তা ভবিষ্যতে তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে রশীদ পড়াশুনায় খুব ভালো করতে পারেননি, কিন্তু উত্তরোত্তর চেষ্টা ও প্রতিভাগুণে ঢাকাস্থ গভর্নমেন্ট আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস কলেজে (১৯৫০-৫৪) তিনি সফলকাম হন। শিক্ষানবিশি পর্বে ঢাকা-কলকাতার মহৎ শিল্পীদের কারুকৃতি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অল্পকাল পরে কলেজের শিক্ষকরূপে হিস্পানি সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি মাদ্রিদ যান। সেখানে সেনত্রাল এসকুয়েলা দেস বেলেস-আরতেস দে সান ফেরনান্দো-তে গিয়ে পাশ্চাত্য শিল্পকলার বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটি তিনি উপলব্ধি করেন। মাদ্রিদে তিনি এক বছর (১৯৫৬-৫৭) ক্ল্যাসিক্যাল প্রতিকৃতি অঙ্কন, বিশেষকরে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্য অধ্যয়ন করেন। দেশে ফেরার পূর্বাহ্নে তিনি প্যারিস ও লন্ডনের জাদুঘরসমূহ দর্শন করেন। দেশে ফিরে ১৯৬০ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি আবার প্যারিস যান। সেখানে চার বছর (১৯৬০-৬৪) বিখ্যাত একোল নাসিওনাল দে বোজার এবং জ্যুলিয় রিভিয়েরা স্টুডিয়োতে তিনি অধ্যয়ন করেন। তিনি জঁ ওজাম্ প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীর নিকটও শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্যারিসে অবস্থানকালে রশীদ একজন ফরাসি ভাস্কর আনীকে বিবাহ করেন।
প্যারিসে বসবাসকালে রশীদ শিল্পের প্রযুক্তিগত বিষয়ে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেন; একাধিক পুরস্কার লাভ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের কমিশন পাওয়া তাঁর সেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে। এ সময় শিল্পী মার্ক শাগাল ও জঁ ল্যুর্সা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। তবে শাগালের অনুকৃতি তাঁর শিল্পকর্মে প্রভাব ফেললেও তাঁর ঐকান্তিক রোম্যান্টিক অনুভূতি ও বাঙালি মনমেজাজ শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রখ্যাত রুশ শিল্পী জঁ ল্যুর্সার দিকেই ধাবিত করে এবং তাঁর পথ ধরেই তিনি শুধু বাংলাদেশে নন, প্রাচ্যভুবনে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প-ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর দ্বারাই তাপিশ্রীর নবযুগের সূচনা হয়। তিনি প্রথমে শুধু সুতা আর পাট, পরে পাট, সুতা আর রেশম দিয়ে ঐতিহ্যবাহী তাঁতের ওপর নিরীক্ষাধর্মী এই মাধ্যমে নিজের স্বপ্নকে রূপায়িত করেন।
আবাল্য পদ্মার যে পরিবর্তনশীল রূপ এবং ঋতুচক্রে মাটি ও মানুষের অপরূপ বৈচিত্র্য রশীদ প্রত্যক্ষ করেছেন, তা তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্মে, বিশেষত, তাপিশ্রীতে মূর্ত হয়েছে। অবশ্য তাপিশ্রীতে তিনি বিমূর্ত চিত্রকলার আঙ্গিক ও বিবিধ ডিজাইনের কল্পিত রূপ উপস্থাপনেরও প্রয়াস পেয়েছেন। এক ধরনের কোমল পেলব আবহ সৃষ্টি এবং রঙের বিন্যাসে মাদকতা আনয়ন তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব। বিষয়বস্ত্তর ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান আগ্রহ বঙ্গের লোকজ কথা ও কাহিনী এবং গান ও নাটক। কখনও বা বাস্তব দৃশ্য তিনি এমন বলিষ্ঠভাবে অঙ্কন করেছেন যাতে তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে।
রশীদ চৌধুরী ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। তিনি খুব দ্রুত তাঁর প্রকাশ মাধ্যম পরিবর্তন করতেন; কখনও বা সাহিত্যচর্চাও করতেন। তাঁর কিছু হূদয়গ্রাহী কবিতা আছে; আছে জাক্ প্রেভের্ এবং রবের দেস্নোস্-এর অনুবাদ, যা তিনি মূল ফরাসি থেকে ভাষান্তরিত করেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি তরুণ কবি-প্রকৌশলী-স্থপতিদের একটি দল নিয়ে বিদ্রোহাত্মক ‘না’ গ্রুপ সৃষ্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
রশীদ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অধ্যয়ন এবং চট্টগ্রাম শহরে একটি চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে একটি শিল্পী চত্বর এবং শ্রীপুরে একটি তাপিশ্রী গ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি দুটি প্রকল্প তৈরি করেছিলেন, যদিও প্রকল্প দুটি নানাকারণে বাস্তবায়িত হয়নি।
একক, দলীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক প্রদর্শনীতে রশীদ উচ্চ প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় তাঁর একটি বড় মাপের একক প্রদর্শনী হয়। তাঁর অজস্র শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ধান কাটা (তৈল, ১৯৫৩), চাকমা তরুণী (ড্রয়িং, ১৯৫৭), প্রকৃতি (তৈল, ১৯৬০), ষড়ঋতু (দেয়াল/তৈল/তাপিশ্রী, ১৯৬৭), রঁদেভু (গুয়াশ, ১৯৬৮), রোমান্স (তাপিশ্রী, ১৯৭০), যাদুঘর (তাপিশ্রী, ১৯৭০), সোনাভানু (তাপিশ্রী, ১৯৭০), বাংলায় বিদ্রোহ (গুয়াশ, ১৯৭১), আমার সোনার বাংলা (তাপিশ্রী, ১৯৭৫), দুর্বিনীত কাল (তৈল, ১৯৮০), আদম (তাপিশ্রী, ১৯৮২), চিত্রাঙ্গদা (তৈল, ১৯৮৩), কাল বৈশাখী (তাপিশ্রী, ১৯৮৫) ইত্যাদি। রশীদ চৌধুরী ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর মারা যান। [মাহমুদ শাহ কোরেশী]