চৌধুরী, অচ্যুৎচরণ
চৌধুরী, অচ্যুৎচরণ (১৮৬৬-১৯৫৩) ইতিহাসবিদ, কবি, বৈষ্ণব তত্ত্ববিশারদ। জন্ম বাংলা ২৩ মাঘ ১২৭২ সালে সিলেট বিভাগের করিমগঞ্জ জেলার মৈনা গ্রামে। পিতা অদ্বৈতচরণ চৌধুরী, মাতা কোটিমণি চৌধুরী। গ্রামের পাঠশালায় কিছু লেখাপড়া করলেও অচ্যুৎচরণ চৌধুরী ছিলেন স্বশিক্ষিত। নিজ আগ্রহে তিনি ইতিহাস ও ধর্মশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন; বিশেষত বৈষ্ণব তত্ত্ব ও সাহিত্যে।
১৯০৪ সালে সিলেটের গিরিশ মধ্য ইংরেজি স্কুলের সহকারী পন্ডিত হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯০৫ সালের ১ আগস্ট থেকে তিনি পাথারকান্দির রাজকাছারিতে কোষাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।
বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করে অচ্যুতচরণ চৌধুরী পুরী, ভুবনেশ্বর, গয়া, বৃন্দাবন, ঢাকাদক্ষিণ প্রভৃতি তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন এবং ঢাকা দক্ষিণে নিজ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠা করেন গৌরবিষ্ণুপ্রিয়া মন্দির।
১৩০৬ সালে আষাঢ় মাসে তিনি শ্রীহট্ট দর্পণ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। দু’বছর পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে ১৩৩১ সনের বৈশাখ থেকে তিনি রমনীমোহন দাসের সঙ্গে সম্পাদনা করেন মাসিক কমলা।
অচ্যুৎচরণ চৌধুরীর সাহিত্য জীবনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত। গ্রন্থটি দুখন্ডে সমাপ্ত। পূর্বাংশ প্রকাশিত হয় ১৩১৭ সনে, উত্তরাংশ ১৩২৩। পূর্বাংশ দুভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের দশটি অধ্যায়ের সিলেটের ভৌগৌলিক অবস্থান এবং দ্বিতীয় ভাগে একত্রিশটি অধ্যায়ে ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত আলোচিত হয়েছে। উত্তরাংশের তৃতীয় ভাগে একত্রিশ অধ্যায়ে বংশবৃত্তান্ত এবং চতুর্থ ভাগে সিলেটের একশ’ এগারোজন ব্যক্তির জীবনী আলোচিত হয়েছে। পরিশিষ্টে সিলেটের অতীতের গ্রন্থাকার ও তাঁদের রচিত গ্রন্থের তালিকা প্রভৃতি সঙ্কলিত হয়েছে। আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রন্থটি বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সমকালের পত্রপত্রিকায় এ গ্রন্থের প্রশংসা করা হয়। তিনি গ্রন্থটি রচনায় যে প্রণালী অবলম্বন করেন, আচার্য যদুনাথ সরকার সেটাকে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আদর্শ বলে উল্লেখ করেন। আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় অচ্যুৎচরণ চৌধুরী শতাধিক বছর পূর্বে যে শ্রম, ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তা বিশেষভাবে প্রশংসনীয় ও উল্লেখযোগ্য।
অচ্যুৎচরণ চৌধুরী বহুশাস্ত্রগ্রন্থ ও ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোতে রয়েছে সাহিত্যকর্মের প্রতি তাঁর মনোযোগের পরিধি ও বিস্তারের সাক্ষর। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল তিন হাজার পুস্তকসহ পুথি ও অন্যান্য বিষয়ের পান্ডুলিপি। এসব সংগ্রহ ও সৃষ্টিকর্মে তাঁর ভক্তিবাদী চিন্তাভাবনা ও মনস্বিতার পরিচয় পাওয়া যায়।
অচ্যুৎচরণ চৌধুরী বৈষ্ণব সাহিত্যবিষয়ক প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ: ভক্তি নির্যাস (১২৯৯), শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামীর জীবনচরিত (১৩০২), প্রেম প্রসঙ্গ (১৩০৪), শ্রীমৎ হরিদাস ঠাকুরের জীবনচরিত্র (১৩০৬), অভিরাম চরিত (১৩০৬), শ্রীমৎ শ্যামানন্দ চরিত (১৩০৮), শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী (১৩০৯), শ্রীমৎ রূপ সনাতন (১৩১২), শ্রীচৈতন্য চরিত (১৩১২), নিতাই লীলা লহরী (১৩১৯), সাধুচরিত (১৩১৯), শান্তিলতা (১৩২০, শ্রীবাল্যসূত্রমের পদ্যানুবাদ (১৩২২), শ্রীগৌরাঙ্গের পুর্বাঞ্চল পরিভ্রমণ বা আসাম ও ঢাকা দক্ষিণ লীলা প্রসঙ্গ (১৩২৮) প্রভৃতি। ১৩৬০ সনের ১০ আশ্বিন তাঁর মৃত্যু হয়। [নন্দলাল শর্মা]