চীনামাটি

চীনামাটি (White Clay or China Clay)  কেওলিন কর্দম মণিক দ্বারা গঠিত উন্নতমানের  কর্দম; প্রধানত সিরামিক শিল্পে ব্যবহূত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে গৃহস্থালি সামগ্রী হিসেবে চীনামাটির তৈরী তৈজসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভূ-পৃষ্ঠে অথবা অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠে (subsurface) চীনামাটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুর ও গোপালপুরে, শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায়, চট্টগ্রাম জেলার হাইটগাঁও ও সাতকানিয়া উপজেলার বাইতুল ইজ্জতে চীনামাটির মজুত রয়েছে। এ ছাড়া দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া, বড়পুকুরিয়া ও দীঘিপাড়া এবং নওগাঁ জেলার পত্নীতলাতে ভূ-পৃষ্ঠের নিকটে চীনামাটি মজুতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

চীনামাটি, নেত্রকোনা

ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে প্রাপ্ত চীনামাটির গুণগত মান উন্নত নয়। এ চীনামাটির সঙ্গে আমদানিকৃত উচ্চ মানসম্পন্ন কর্দম মিশিয়ে তা দেশের  সিরামিক শিল্প কারখানাগুলিতে ব্যবহূত হয়ে থাকে।

পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জি.এস.পি, বর্তমান  বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর- জি.এস.বি) ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত (দুর্গাপুর বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা) ভেদিকুরা নামক স্থানে প্রথম চীনামাটির সন্ধান লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে সে অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক মানচিত্রাঙ্কণ সম্পন্ন হয়। ১৯৬৪-৬৫ সালে জিএসপি অত্র এলাকায় ১৩টি  কূপ খননের মাধ্যমে চীনামাটি মজুতের গভীরতা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৭৮, ১৯৮০ এবং ১৯৮৩ সালে জি.এস.বি এ এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধানকার্য পরিচালনা করে। অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায় যে, পশ্চিমে ভেদিকুরা থেকে মাইজপারা এবং পূর্বে ফুন্ডাকুরা থেকে গোপালপুর পর্যন্ত চীনামাটির স্তর বিস্তৃত রয়েছে। প্রায় ৩.৮৪ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৬০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত এ চীনামাটির মজুতের পরিমাণ ২.৪৭ মিলিয়ন টন বলে পরিমাপ করা হয়। এ চীনামাটিকে বিজয়পুর চীনামাটি হিসেবে নামকরণ করা হয়।

জি.এস.বি ১৯৯০ সালে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার ভূরাঙ্গা এলাকায় চীনামাটির মজুত আবিষ্কার করে। প্রায় ০.৪০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত চীনামাটি ক্ষেত্রটিতে মজুতের পরিমাণ ০.০০১৩ মিলিয়ন টন। এর পূর্বে জি.এস.বি ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার অন্তর্গত হাইটগাঁও এলাকায় চীনামাটির কয়েকটি বিক্ষিপ্ত মজুত আবিষ্কার করে। এ সকল মজুতের মোট পরিমাণ ০.০০১৯ মিলিয়ন টন মাত্র। একই জেলার সাতকানিয়া উপজেলার বাইতুল ইজ্জত এলাকায় আবিষ্কৃত চীনামাটি মজুতের পরিমাণ ০.০০২৫ মিলিয়ন টন। আবিষ্কৃত এ সকল চীনামাটি তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের।

১৯৬৫ সালে নওগাঁ জেলার পত্নীতলাতে জিএসপি অনুসন্ধান চালানোর সময় সর্বপ্রথম ভূ-পৃষ্ঠের ৩৪০ মিটার থেকে ৩৫০ মিটার গভীরতায় অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠীয় চীনামাটির সন্ধান লাভ করে। মধ্যপাড়া এলাকায়  কঠিন শিলা অনুসন্ধানের লক্ষ্যে খননকার্য চালানোর সময় ১৯৭৪ সালে জি.এস.বি ভূ-পৃষ্ঠের ১২৮ থেকে ১৫৬ মিটার গভীরতায় চীনামাটির সন্ধান পায়। প্রি-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের কঠিন শিলার উপরিভাগে এ মাটির সন্ধান পাওয়া যায়। এ চীনামাটি স্তরের পুরুত্ব ১.২ মিটার থেকে ৬.৪ মিটার পর্যন্ত এবং প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত এ খনিজের মজুত প্রায় ১৫ মিলিয়ন টন।

১৯৮৫ সালে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়াতে  কয়লা অনুসন্ধানের লক্ষ্যে খননকার্য চালানোর সময় জি.এস.বি চীনামাটি আবিষ্কার করে। ভূ-পৃষ্ঠের ১১৮ মিটার থেকে ১৮৪ মিটার গভীরতা পর্যন্ত স্তরে পার্মিয়ান গন্ডোয়ানা স্তরসমষ্টির উপরে এ চীনামাটি স্তর অবস্থিত। এ স্তরের পুরুত্ব ১.৯৮ মিটার থেকে ১২.৫ মিটার পর্যন্ত এবং প্রায় ১ বর্গ কিমি বিস্তৃত এলাকায় মজুতের পরিমাণ ২৫ মিলিয়ন টন। একই ভাবে কয়লা অনুসন্ধানের লক্ষ্যে খননকার্য চালানোর সময় জি.এস.বি ১৯৯৪ সালে দিনাজপুর জেলার দিঘিপাড়ায় চীনামাটির সন্ধান লাভ করে। ভূ-পৃষ্ঠের ৩২৫ থেকে ৩২৮ মিটার গভীরতায় গন্ডোয়ানা স্তরসমষ্টির উপরে এ খনিজের অবস্থান। এটির বিস্তারিত অনুসন্ধানকার্য এখনও সম্পন্ন হয় নি। তবে অন্তর্ভূ-পৃষ্ঠীয় খনি থেকে চীনামাটি উত্তোলন অনেকাংশে ব্যয়বহুল। [কিউ.এম আরিফুর রহমান]