চা শিল্প
চা শিল্প উনিশ শতকে সিলেটে এবং আসামে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রধানত ব্রিটিশ (ইংরেজ, স্কটিশ, আইরিশ) চা-করগণ (Tea Planters) সিলেটের টিলাভূমি এবং আসামের উচ্চভূমিতে ব্যাপক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদনের সূচনা করে। ১৮৩৯ সালে বেশকিছু ব্রিটিশ পুঁজিপতি এবং ভারতীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যেমন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাবু মতিলাল শীল, হাজী হাশেম ইস্পাহানি এবং অন্যান্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় আসাম টি কোম্পানি। লন্ডনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কোম্পানির নাম ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৮৩৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির প্রাথমিক মূলধন ছিল প্রায় ৩ লক্ষ পাউন্ড (৫ লক্ষ ডলার)। এই কোম্পানি গঠনের পরপরই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল টি এসোসিয়েশন এর সঙ্গে একীভূত হয়।
রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে আসামের উঁচু অঞ্চলে চা গাছের সন্ধান পান। এরপর ১৮৫৫ সালে সিলেটের চাঁদখানি টিলায় দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও ‘বন্য প্রজাতির’ চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেও চা উৎপাদন শুরু হয়। এখানে চা উৎপাদনের জন্য চীন থেকে চারা আমদানি করা হয় এবং কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদিত চীনা প্রজাতির চা গাছ রোপন করা হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে লাল চাঁদ ও মাটিরাঙ্গা নামে আরো দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রথমদিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। কিন্তু উনিশ শতকের ষাটের দশকে ব্যাপক মন্দায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠার তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে চা শিল্প ধীরে ধীরে বড় বড় কোম্পানির আয়ত্তে চলে আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ওই মন্দার পর সিলেটের চা শিল্পে জেমস ফিনলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে উনিশ শতকের শেষদিক হতে ক্ষুদ্র একটি দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণি চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়। তবে দেশিয় উদ্যোক্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হলেও বিদেশি কোম্পনিগুলির আধিপত্য কখনই বিঘ্নিত হয় নি। কারণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং চা বিপণনের জন্য দেশিয় চা করগণ ইউরোপীয়দের উপরই নির্ভর করত। তবে এই শিল্পের মাধ্যমেই দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরণের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দেশীয় চা বাগানের অনেক হিন্দু মালিক দেশ ত্যাগ করেন এবং ১৯৪৭-৭১ কালপর্বে এই শূণ্যস্থান দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু পুঁজিপতি এবং উত্তর ভারত থেকে পাকিস্তানে আগত উর্দুভাষী মুসলিম ধনিক শ্রেণি।
বাংলাদেশের চা বাগানগুলির মালিকানা প্রধানত তিন ধরণের, ক) স্টারলিং কোম্পানি, খ) বাংলাদেশি কোম্পানি এবং গ) ব্যক্তি মালিকানা। যে সকল চা বাগানের মালিক ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ তাদেরই বলা হয় স্টারলিং কোম্পানি। দেশীয় যে সকল কোম্পানি ১৯১৩ সালের কোম্পানি অ্যাক্ট দ্বারা গঠিত সেগুলো বাংলাদেশি কোম্পানি। স্টারলিং কোম্পানির চা বাগানগুলি আয়তন ও চা উৎপাদনের দিক থেকে বৃহত্তম (গড় আয়তন ১৬৪৮ একর)। এরপর রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগান (গড় আয়তন ৬৬৯ একর) এবং সবচেয়ে ছোট বাগানগুলি মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন (গড় আয়তন ৩৪৩ একর)।
উনিশ শতকে ভারতে বাণিজ্যিক চা উৎপাদনের সময় প্রথমেই চীনা প্রজাতির চারা এবং চীনা শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করা হয়। এর ফলে দেখা যায়, ৪২ হাজার চীনা প্রজাতির চারা কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদন করে দার্জিলিং ও আসামে প্রেরণ করা হয়। তবে এই চারাগুলি অধিকাংশই পথিমধ্যে মারা যায় এবং বাকিগুলি মারা যায় রোপণের পর। এই বিপর্যয় বস্ত্তত ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এরপর থেকে বিশেষজ্ঞগণ চীনা প্রজাতির পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত চা গাছের উন্নয়নে বেশি নজর দেন। এভাবেই স্থানীয় ও চীনা প্রজাতির সমন্বয়ে তৈরি শংকর প্রজাতির (Hybrid Tea) চা-এর পরিবর্তে দেশজ চা উৎপাদনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮৫১ সালে ‘আসাম ব্রান্ড টি’ রাজকীয় অনুমোদন লাভ করে। সিলেটে ১৮৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি দেশজ চা গাছ আবিষ্কৃত হয় এবং এতে ইউরোপীয় চা-কর এবং ব্রিটিশ প্রশাসকদের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। তারা নিশ্চিত হন যে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং যোগাযোগের দিক থেকে সিলেটের মত একটি অগ্রসর এলাকায় চা উৎপাদন বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক হবে। সিলেটের তৎকালীন ম্যাজিট্রেট টি.পি লারকিন্স বঙ্গদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, চাঁদখানি টিলায় প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর চা গাছ জন্মায় এবং এগুলির গুণাগুণ বিচারের জন্য নমুনা হিসেবে কিছু চা গাছ কলকাতাস্থ ভারতীয় কৃষি সমিতির (Indian Agriculture Society) কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। লারকিন্স বঙ্গদেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিকে অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন দেশজ প্রজাতির চা গাছ আবিষ্কারক মোহাম্মদ ওয়ারিসকে ৫০ টাকা পুরস্কার প্রদান করেন। এভাবে একজন দেশিয় ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
প্রথম পর্বে বিদেশি কোম্পানিগুলির আধিপত্য উনিশ শতকের ষাটের দশককে বলা যায় চা শিল্প বিকাশের প্রথম পর্যায়। ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গদের কাছে চা শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ডরাশের (Gold Rush) সমতুল্য। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পশু চিকিৎসক, জাহাজ চালক, রসায়নবিদ, দোকানদার, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই চা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন। তবে অতিমাত্রায় বিনিয়োগের ফলে অচিরেই দেখা দেয় মহামন্দা। তবে এই মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। সত্তরের দশকে বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে চা শিল্প অনেকটা স্থিতি লাভ করে। আশির দশকে কোম্পানি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাগানগুলি ক্রয় করে নেয় এবং চা শিল্পে বিনিয়োগ হয় বিরাট অংকের পুঁজি।
সারণি ১ চা শিল্পে ইউরোপীয় কোম্পানি ও এজেন্সি হাউজের অবস্থান।
এজেন্সি হাউজের নাম | জমির পরিমাণ (একর) |
জেমস ফিনলে | ২৬,৯৩৫ |
অক্টাভিয়াস স্টিল | ১৪,৭৭৬ |
ম্যাকলিওড এন্ড কোম্পানি | ৫৩৩৭ |
শ এবং ওয়ালেস | ৪১৮০ |
বারলো এন্ড কোম্পানি | ৩২৪১ |
প্ল্যান্টার্স স্টোরস এন্ড এজেন্সিস | ৩০২৮ |
কিং হ্যামিলটন এন্ড কোম্পানি | ২০৯৫ |
ডানকান ব্রাদার্স | ১৮৪৮ |
ব্যারি এন্ড কোম্পানি | ১৩১৫ |
উইলিয়ামসন এন্ড ম্যাগর | ১২৮০ |
জে. ম্যাকিলিক্যান | ১২১৯ |
ম্যাকনিল | ৮৪৯ |
এন্ড্রু ইউল | ৭৯৯ |
গ্রিন্ডলে | ৬১৬ |
কিলবার্ন কোম্পানি | ৪০০ |
ওয়েকার | ৩২৭ |
ডব্লিউ. ক্রেসওয়েল | ২৫৫ |
ন্যাশনাল এজেন্সি | ২৩৭ |
মোট জমির পরিমাণ (একর) | ৬৮,৭৩৭ |
বাংলাদেশের চা শিল্পের বিকাশে জেমস্ ফিনলে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৭৪৫ সালে গ্লাসগোতে তিনি এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র কিরকম্যান ফিনলে এই কোম্পানির ব্যবসা আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতে বিস্তৃত করেন। ১৮৬১ সালে জন ম্যুর এই কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ার কিনে নতুন মালিক হন এবং কোম্পানিটির নতুন নামকরণ হয় ফিনলে অ্যান্ড মুর। কিন্তু জনসমুক্ষে এটি জেমস ফিনলে হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮২ সালে জন মুর নর্থ সিলেট টি কোম্পানি এবং সাউথ সিলেট টি কোম্পানি নামে দুটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের আশির দশকে জেমস ফিনলে কোম্পানির মূলধন ছিল ৫৫ লক্ষ পাউন্ড। ফিনলে কোম্পানির চা বাগানের সিংহভাগই বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটে অবস্থিত। এ কোম্পানির কিছু বাগান আসাম, দক্ষিণ ভারত এবং শ্রীলংকায়ও রয়েছে। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার একর জমিতে ফিনলে কোম্পানির চা বাগান ছিল এবং প্রায় ৭০ হাজার লোক এই কোম্পানিতে কর্মরত ছিল। উনিশ শতকের শেষ থেকে ফিনলে কোম্পানির চা বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রসারিত হয় এবং চা একটি অতি সুলভ ও সস্তা জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত টেইলর ম্যাপ অনুযায়ী সিলেটে ফিনলেসহ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির চা বাগানের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। জেমস ফিনলে প্রথমত সরকার থেকে পতিত ভূমির ইজারা নেয়; দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরার মহারাজার ভূমি অধিগ্রহণ করে এবং তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের জমি ক্রয় করে দক্ষিণ সিলেটের চা শিল্পে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
উনিশ শতকের শেষে সিলেট চা শিল্পে অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সিলেটে ১৮৯৩ সালে ২০৬,২৭,০০০ পাউন্ড চা উৎপাদিত হয় যা আসামের শীর্ষ চা উৎপাদনকারী জেলা শিবসাগরের সমান। ১৯০০ সাল পর্যন্ত উৎপাদনের এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে। ১৯০৪-০৫ সালে সিলেটে মোট ১২৩টি চা বাগান ছিল যার মধ্যে ১১০টি ছিল ইউরোপীয় মালিকানাধীন। ১৯১০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ৯৫ শতাংশ চা বাগানের মালিক ছিল বিদেশি এবং বাকি ৫ শতাংশের মালিকানা ছিল স্থানীয় উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রণে। ১৯২০ সালে স্থানীয়দের মালিকানা প্রায় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়।
চা শিল্পে আরো অগ্রগতি উনিশ শতকের সত্তরের দশকে চা উৎপাদনের জন্য যাবতীয় যন্ত্রপাতি ব্রিটেন থেকে আমদানি করা হতো। প্রথমদিকে একটি প্রধান সংকট ছিল জ্বালানি সমস্যা যা মূলত বনজ কাঠ থেকে তৈরি চেরাকলের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কয়লা ও তেল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। জ্বালানি সমস্যার নিরসনের ফলে চা-এর উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। নববইয়ের দশকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে-এর পূর্ণতা এবং নৌপথের বিস্তৃতি চা শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের ফলে চা পরিবহণের খরচ ব্যাপকহারে হ্রাস পায়। জমির গুণগতমান নির্ণয়ের পরীক্ষার বিষয়েও বৈজ্ঞানিক সাফল্য আসে। হ্যারল্ড ম্যান নামক একজন ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, সিলেটের টিলায় এবং অন্যান্য কিছু নির্ধারিত জমিতে উৎকৃষ্ট মানের চা উৎপাদন সম্ভব। চা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতার জন্য বিদেশি উদ্যোক্তাগণ চা শিল্পে বরাবরই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। তবে তাদের এই অর্জন এসেছে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক তথ্য বিনিময় এবং দেশজ জ্ঞানের সহায়তা নিয়ে।
সিলেটের দুজন বিখ্যাত আইনজীবী হরেন্দ্রচন্দ্র সিংহ এবং প্রমোদচন্দ্র দত্ত ওয়ার্কম্যান ব্রিচ অব কনটাক্ট নামে একটি গ্রন্থ লেখেন যেখানে চা শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের খুঁটিনাটি তুলে ধরা হয়। এসব আইনি তথ্যের মাধ্যমে দেশীয় ও ইউরোপীয় উভয় উদ্যোক্তারাই লাভবান হন। ১৯৩৩ সালে অবিনাশ চন্দ্র নামে একজন দেশীয় ম্যানেজার চায়ের চাষ এবং এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি দাবি করেন যে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছে গ্রন্থটিতে যা উৎপাদনকারীদের জন্য সহায়ক হবে। দেশীয়দের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি ছিল টিলা বাবুগণ যারা জমির গুণাগুণ পরীক্ষা এবং স্থানীয় আবহাওয়া সম্পর্কে ইউরোপীয় চা-করদের অবহিত করত। কিছু ক্ষেত্রে অনেক টিলাবাবুই নতুন বাগান প্রতিষ্ঠা করার পর ইউরোপীয়দের হাতে তুলে দিয়েছেন। যেমন দি নিউ সিলেট টি এস্টেটের প্রথম মালিক ছিলেন একজন বাবু। পুঁজিবাদী কায়দায় চা শিল্পের বিস্তারে দেশিয় ভদ্রলোক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
চা শিল্পে দেশীয় উদ্যোক্তা এবং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ১৮৩৯ সালে ইউরোপীয়রা আসাম টি কোম্পানি গঠন করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ভদ্রলোক শ্রেণির সহযোগিতা নিয়ে। ১৮৭৬ সালে কাছাড় নেটিভ স্টক কোম্পানি গঠিত হয় শুধু সিলেটের পুঁজিপতিদের নিয়ে। এই কোম্পানি হচ্ছে আসাম এবং বঙ্গদেশের প্রথম দেশিয় চা কোম্পানি যার মালিক ছিলেন স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ। সিলেটের একজন বিখ্যাত আইনজীবী মোশাররফ আলী তাঁর কতিপয় হিন্দু বন্ধুদের নিয়ে এই কোম্পানি গঠন করেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসাম সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। মোশাররফ আলীর পুত্র মনোয়ার আলী আসাম আইনসভার সদস্য ও আসাম সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পূর্বপর্যন্ত এই কোম্পানির লভ্যাংশ মোশাররফ আলীর উত্তরাধিকারীগণ গ্রহণ করেছেন। ১৮৮০ সালে গঠিত ভারত সমিতি লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি কালিনগর চা বাগান পরিচালনা করত। ভারত সমিতির অনুমোদিত মূলধন ছিল ৫ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ১,০০,৪৭৫ রুপি। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্দেশ্বর টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির মালিকানায় পরিচালিত হতো ইন্দেশ্বর চা বাগান। এই কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ছিল ১ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮৮,৭৮৫ রুপি। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, দেশিয় কোম্পানিগুলির আর্থিক সামর্থ্য ছিল কম এবং এদের নিজস্ব কোনো কারখানা ছিল না। চা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য তারা প্রতিবেশী ইউরোপীয়দের কারখানায় প্রেরণ করত। এভাবে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইউরোপীয় চা করগণ স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে অনেক বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। যেমন জমিদার ব্রজনাথ চৌধুরী সিলেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্কটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সকে তার জমিদারির এক বিরাট অংশ চা বাগানের জন্য বন্দোবস্ত দেন। বিনিময়ে তিনি ডানকান ব্রাদার্সের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে ১,০৬৫ একর জমিতে মহাবীর টি এস্টেট নামে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এই চা বাগানটি ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম মানিক্য বাহাদুরের নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
সারণি ২ চা শিল্পে দেশিয় মালিক ও কোম্পানির নাম।
দেশীয় এজেন্ট ও মালিক | চা কোম্পানির নাম | চা বাগান |
গগন চন্দ্র পাল, কলকাতা | বিদ্যানগর টি এস্টেট | বিদ্যানগর, চাঁদনিঘাট, রামনগর, চুনাতিগুল, কৃষ্ণনগর |
দত্ত এন্ড সন্স, কলকাতা | দক্ষিণগুল টি এস্টেট | দক্ষিণগুল, বড়লেখা |
এন.এন চৌধুরী, কলকাতা | গোবিন্দপুর টি এস্টেট | গোবিন্দপুর |
গগণ দত্ত, কলকাতা | কালিনগর টি এস্টেট | কালিনগর, রাতবাড়ি |
ঈশ্বরচন্দ্র দত্ত এন্ড প্রসন্ন কুমার দত্ত | মদনপুর টি এস্টেট | মদনপুর, লাতু |
উৎস্য Compiled from Taylor’s Map, 1910.
১৯১১ সালে আসামের প্রথম দেশিয় মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ সিলেটে নেতৃস্থানীয় হিন্দুদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন অল ইন্ডিয়া টি কোম্পানি যার অনুমিাদিত মূলধন ছিল ১০ লক্ষ রুপি এবং পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭,১০,৯৮৫ রুপি। অচ্যুতচরণ চৌধুরী ১৯১০ সালে তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সে সময় ১০টি চা বাগানের মালিক ছিলেন দেশিয় উদ্যোক্তাগণ। সিলেটের জনৈক জমিদার নবাব আলী আমজাদ খান রঙ্গির ছড়া নামে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি দেশিয় মালিকানাধীন চা বাগানের মধ্যে সর্ববৃহৎ। অনেক উচ্চ উপাধিধারী ও সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলমান চা শিল্পে আগ্রহ দেখিয়েছেন। ১৯০৪ সালে মুহম্মদ বখত মজুমদার, করিম বখ্শ, গোলাম রাববানী, আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া যৌথভাবে ব্রাহ্মণছড়া চা বাগানের মালিক ছিলেন। জমিদার ও রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য আব্দুর রশিদ চৌধুরী এবং তাঁর পুত্র আমিনুর রশিদ চৌধুরী সিলেটে চা বাগান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সুনাম অর্জন করেছেন এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত চা বাগানগুলি এখনও চালু আছে।
১৯২১-২২ সালে আসাম প্রদেশের চা শিল্পে সর্বমোট ২৯টি দেশিয় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন লাভ করে যার মধ্যে ২৩টি ছিল সিলেটে, ৩টি কাছাড়ে এবং বাকি ৩টি আসামের অন্যান্য জেলায় রেজিস্ট্রিকৃত। ব্রিটিশ আমলা ও চা করদের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, আসাম প্রদেশের মধ্যে ৯০ শতাংশ ইউরোপীয়দের ক্লাব ছিল মূলত সিলেট শহর এবং এ জেলার চা বাগানগুলিতে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সমগ্র আসাম প্রদেশে চা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিলেট। ওই সময় আসামে ১১৪টি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি নিবন্ধিত হয়েছিল যার মধ্যে চা কোম্পানি ছিল এক তৃতীয়াংশ। চা কোম্পনিগুলির মূলধন ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়া কলকাতার বাঙালি ও মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা সিলেটের দেশিয় চা-কর এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় একটি বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় চা শিল্পের বিপণন এবং বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে কলকাতা কেন্দ্রিক বেশকিছু দেশিয় এজেন্সি হাউজ।
পাকিস্তান আমল চা শিল্প ১৯৪৭ সালের পর এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে মালিকানায় এক উল্লেখযোগ্য অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে চলে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ববাংলা এবং সিলেটের অনেক হিন্দু জমিদার ও পেশাজীবী সিলেট পরিত্যাগ করে ভারতে অভিবাসন নেন। তাঁদের অনেকেই পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন চা শিল্পে। তাঁদের প্রস্থান এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। এই শূণ্যতা পূরণে যারা এগিয়ে আসেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি। এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ১৯৬৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১১৪টি চা বাগানের মধ্যে ৫৬টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি, ৪৭টির মালিক ইউরোপীয় এবং মাত্র ১১টির মালিক বাঙালি উদ্যোক্তা। ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ৭৪টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ আমল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চা শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ শিল্পকে পূর্বের অবস্থায় পুনঃস্থাপিত করার জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল চা শিল্পে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ, উৎপাদন খরচ কমানো এবং বিপণন প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী করা।
চা শিল্পে পাকিস্তান আমলের ন্যায় বাংলাদেশ আমলের প্রথম তিন দশক অর্থাৎ ১৯৭০, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ব্রিটিশ/স্কটিশ কোম্পানিগুলির আধিপত্য অব্যাহত ছিল। কারণ বিদেশি স্টারলিং কোম্পানির বাগানগুলো আয়তনের দিক থেকে ছিল দেশিয় বাগানের তিনগুণ এবং এসব বাগানে একর প্রতি উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে ১৩৫টি সিলেট বিভাগে, ২৩টি চট্টগ্রামে এবং ৪টি নবগঠিত রংপুর বিভাগে। ২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ বাৎসরিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩০টি চা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে ৯ম চা উৎপাদনকারী দেশ ছিল, কিন্তু ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে নেমে আসে। তবে ২০১০ সালে চা উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পায়। চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশে একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে রপ্তানির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০০৯ সালে চা রপ্তানি প্রায় ৬৮% কমে ২.৫৩ মিলিয়ন কেজিতে নেমে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিবছর প্রয়োজন ৫৭ লক্ষ কেজি চা। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে এবং রপ্তানি করে ৩১ মিলিয়ন কেজি। বর্তমানে উৎপাদন করে প্রায় ৬০ মিলিয়ন কেজি এবং রপ্তানি করে মাত্র ৩ মিলিয়ন কেজি।
১৯৪৭ সালের পূর্বে চা ক্রয়বিক্রয় বা নিলামের মূল কেন্দ্র ছিল লন্ডন। ভারত বিভাগের পর ব্রিটিশ চা করগণ এবং পুঁজিপতিরা লন্ডনেই চা-এর নিলাম পছন্দ করতেন। কিন্তু ভারত কিছুদিনের মধ্যে কলকাতায় চা-এর নিলাম শুরু করলেও পাকিস্তান প্রথমে লন্ডনে এবং পরে চট্টগ্রামে চা-এর নিলামের আয়োজন করত। নিলামে অংশগ্রহণকারী এজেন্সিগুলি চা উৎপাদনকারীদের ব্রোকার সেবা এবং অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করে। এরা ঐতিহ্যগতভাবে উৎপাদনকারীকে অর্থপ্রদান থেকে শুরু করে ব্যাংক ঋণ এবং এল.সি খোলার সুবিধাদি প্রদান করে আসছে। এছাড়াও ব্রোকার হাউজগুলি বিশ্ববাজারে চা-এর বাজারকে স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করার ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে। চা-এর গুণাগুণ পরীক্ষা, ক্যাটালগিং করা, স্ট্যাপলিং, মূল্যায়ন ও পরিসংখ্যান সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে ব্রোকার হাউজগুলি। অন্যদিকে ব্যাংকারগণ শিপিং ডকুমেন্টস দেখে চা উৎপাদনকারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।
চা শিল্পে কর্মসংস্থান চা শিল্পে প্রায় দেড় লক্ষ লোক কর্মরত আছে। এটি একটি শ্রমঘন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প বিধায় চা উৎপাদনের জন্য বিপুল শ্রমিকের প্রয়োজন। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে চা শিল্পে ১ লক্ষ ২০ হাজার পুরুষ ও নারী শ্রমিক নিয়োজিত ছিল এবং তাদের উপর নির্ভরশীল ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার পোষ্য। বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের অধিকাংশই ভারত থেকে আগত, কিন্তু বর্তমানে তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। মধ্য উনিশ শতকে এদের পূর্বপুরুষ মূলত ভারতের ছোট নাগপুর-ঝাড়খন্ড অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে। চা-শ্রমিকদের পূর্বপুরুষদের অনেকে এসেছে বিহার, ঊড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্রিশগড় অঞ্চল থেকে। কুলি নামে পরিচিত চা-শ্রমিকরা স্থায়ীভাবে নির্মিত চা-কুলি লাইনের অপরিসর গৃহে বসবাস করছে। বংশানুক্রমিক চা-শ্রমিক সমাজেও এখন কিছুটা বেকার সমস্যা দেখা দিয়েছে। [আশফাক হোসেন]
গ্রন্থপঞ্জি James Finlay Papers, UGD91/8/3/6/2/16; H Cottam, Tea Cultivation in Assam, Colombo, 1877; Harold H Mann, Tea Soils of Cachar and Sylhet, Calcutta, 1903; Avinas Chandra Dutta, Handbook of Tea Manufacture, Habiganj, 1933; Anonymous, James Finlay and Company Limited: manufacturers and East India merchants, 1750-1950, Glasgow, 1951; Proceedings of the Tea Conference held at Sylhet on 26 and 27 January 1949, Ministry of Commerce, Government of Pakistan, 1949; GP Stewart, The Rough and Smooth (autobiography); Bangladeshiyo Cha Sangsad, Annual Report, Srimongal, 1984.
আরও দেখুন চা; বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ চা বোর্ড।