চলচ্চিত্র উৎসব

চলচ্চিত্র উৎসব  চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান, যেখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা, চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা ও সেমিনার এবং এ সংক্রান্ত প্রকাশনা, পোস্টার ও স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ইতালির ভেনিস শহরে ১৯৩২ সালে, পরে আরও অনেক স্থানে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হতে থাকে, যেমন: মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৩৫), কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৪৬), বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৫১), ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কলকাতা (১৯৫২) প্রভৃতি।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশিয় চলচ্চিত্র উৎসব। আখতার জং কারদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাভেরা মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৫৯), সুভাষ দত্তের সুতরাং এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৬৫) অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড তাসখন্দ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৭২), শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দীন শাকের পরিচালিত সূর্য-দীঘল বাড়ী মেনহেইম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৮০) এবং মোরশেদুল ইসলামের আগামী নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ভেনিস, কায়রো, বার্লিন, কান, টোকিও, কমনওয়েলথ, নমপেন, লোকার্নো, কার্লোভেরি, ডানকান, অবার হাউজেন, পিয়ং ইয়ং, তেহরান, বৈরুত, কলকাতা, মুম্বাই, কলম্বো চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দেশীয় চলচ্চিত্র উৎসব। ঢাকার নাজ প্রেক্ষাগৃহে ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় শিশু চলচ্চিত্র উৎসব, এর কিছু পরে অনুষ্ঠিত হয় জার্মান চলচ্চিত্র উৎসব। ১৯৬৫ সালে সরকারি উদ্যোগে ঢাকার বলাকা প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত হয় এদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এতে মোট ১২টি দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল অাঁদ্রে ভাইদার ক্যানাল (পোল্যান্ড), আলা রেনের হিরোশিমা মন আমুর (ফ্রান্স), ও সত্যজিৎ রায়ের মহানগর (ভারত)। এ ছাড়া প্রদর্শিত হয় যুক্তরাজ্যের দ্য ফার্স্ট লেডি, গণচীনের নিউ ইয়ার্স সেক্রিফাইস, চেকোশ্লোভাকিয়ার জাভারেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের হ্যামলেট, ব্রাজিলের গড অ্যান্ড দ্য ডেভিল ইন দ্য ল্যান্ড অব দ্য সান, জাপানের দ্য প্যাসিফিকস, ইরানের সোয়ালোজ রিটার্ন টু দেয়ার নেস্ট ও তুরস্কের ওয়াটারলেস সামার। পাকিস্তান প্রযোজক সমিতির উদ্যোগে ১৯৬৫-এর আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পুরস্কার প্রদান, সেমিনার, সংকলন প্রকাশ, পোস্টার প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মত বিনিময় ইত্যাদি ছিল উৎসবের কর্মানুষ্ঠান। উৎসবে প্রদর্শিত উভয় প্রদেশের ১২টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছিল জহির রায়হানের কখনো আসেনি ও কাঁচের দেয়াল, সালাহউদ্দীনের সূর্যস্নান, খান আতাউর রহমানের অনেক দিনের চেনা, রহমানের মিলন ও মুস্তাফিজের তালাশ। প্রতিযোগিতায় কাঁচের দেয়াল ৯টি পুরস্কার পায়। উৎসবে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শিকওয়া, হীরা আওর পাত্থর, দামান, আওলাদ, কর্তার সিং ও ফেরেঙ্গি। ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে একক বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসব যেমন বুলগেরীয় চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৬৯), মিশরীয় চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৭০), পোলিশ চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৭৩), ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৭৪), রুমানীয় চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮০) এবং যুগোশ্লাভ চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৮০)।

সরকারিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১-এর মার্চ-এপ্রিলে। অপ্রতিযোগিতামূলক এ উৎসবে ১৮ দেশের সর্বমোট ৩৫টি চলচ্চিত্র দেখানো হয়। মূল উৎসবে প্রদর্শিত ১৪টি চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পোল্যান্ডের দ্য কন্ডাক্টর, ইন্দোনেশিয়ার বাউ হাতি মামা, হাঙ্গেরির ম্যাগারক, ভারতের হীরক রাজার দেশে, জাপানের পোর্ট আর্থার, মঙ্গোলিয়ার আনফরগেটবল অটাম, চীনের লিটল ফ্লাওয়ার ও বাংলাদেশের সূর্য-দীঘল বাড়ী। উৎসবের তথ্য বিভাগ কর্তৃক প্রদর্শিত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ছিল শ্রীলঙ্কার দ্য গার্লস, ভারতের সিংহাসন ও কস্ত্তরী এবং পাকিস্তানের মিস হংকং ও সায়খা। এ ছাড়া এ উপলক্ষে সেমিনারও অনুষ্ঠিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এবং ভারতের প্রতিনিধিরা উৎসবে অংশ নেয়। ১৯৮২-তে ঢাকার মধুমিতা হলে অনুষ্ঠিত হয় ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব। ‘সার্ক’ দেশসমূহের চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় ডিসেম্বর ১৯৮৫-তে। এ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ১১টি ছবি প্রদর্শিত হয়। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ছিল ভারতের সত্যজিৎ রায়ের পরশপাথর, ঘরে বাইরে এবং মৃণাল সেনের খারিজ।

ঢাকায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সনের ডিসেম্বরে। ‘বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফোরাম’ প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসবে ২৫টি দেশের ১৫৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে ছিল নানুক অব দ্য নর্থ, লুইজিয়ানা স্টোরি, ড্রিকটার্স, কোলফেস, স্টপ জেনোসাইড, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম প্রভৃতি। প্রতি দুই বছর অন্তর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইতোমধ্যেই এ উৎসবটি পৃথিবীর চিত্রামোদীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগেও ঢাকায় ১৯৯২ সাল থেকে একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ শিশু চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদ, বিদেশি দূতাবাস এবং চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনের উদ্যোগেও মাঝে মাঝে দেশি-বিদেশি ছবির উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কয়েকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, ভিডিও চিত্রের উৎসবও হয়েছে। এসব উৎসব দেশে সচেতন দর্শক সৃষ্টির পাশাপাশি উন্নত চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করছে।  [অনুপম হায়াৎ]