চন্দ, রমাপ্রসাদ
চন্দ, রমাপ্রসাদ (১৮৭৩-১৯৪২) বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় প্রাচীন ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সাহিত্য এবং দর্শনে স্থায়ী অবদান রাখেন। একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে তিনি বেশ কিছু সংখ্যক অমূল্য গবেষণা কর্ম প্রকাশ করেন, যা তাঁর শ্রমসাধ্য অধীত বিদ্যাকে সমৃদ্ধ করেছে। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, পালি এবং সংস্কৃত ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল।
রমাপ্রসাদ ১৮৭৩ সালের ১৫ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনার শ্রীধরখোলায় জন্মগ্রহণ করেন। কালিপ্রসাদ চন্দের সন্তান রমাপ্রসাদ ১৮৯১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৯৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) ও ১৮৯৬ সালে ডাফ কলেজ (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে বি.এ পাস করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর তিনি প্রায় পাঁচ বছর বেকার ছিলেন এবং এ সময়ে চন্দ ইমপিরিয়েল লাইব্রেরিতে (বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থাগার) গবেষণায় লিপ্ত থাকেন। অচিরেই তিনি কলকাতার হিন্দু স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি লাভ করেন।
উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষক রসময় মৈত্র রায়বাহাদুর আর.পি চন্দকে জ্ঞান অন্বেষণ অব্যাহত রাখতে উৎসাহ দেন। স্যার এইচ রিজলী সম্পাদিত ১৯০১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট রমাপ্রসাদ চন্দকে ক্ষুব্ধ করে। রিপোর্টে বর্ণিত রিজলীর মতামতকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি অভিযোগ তোলেন যে, রিজলীর বক্তব্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত। তাঁর দুটি মৌলিক প্রবন্ধ East and West-এ প্রকাশিত হলে তা সমসাময়িক পন্ডিত ব্যক্তিদের প্রশংসা অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এই প্রবন্ধসমূহ Indo Aryan Races নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক গবেষণা কর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
১৯০৫ সালে আর.পি চন্দ রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে বদলি হয়ে আসেন। এখানে তিনি সে সময়ের খ্যাতনামা দুজন পন্ডিত শরৎকুমার রায় এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-এর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৯০৮ সালে আর.পি চন্দের প্রবন্ধ ‘The Origin of the Bengal People’ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে (Bengal Literary Conference) উপস্থাপিত হয়। সম্মেলনটি রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রাসাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। চন্দের প্রবন্ধটি উপস্থিত পন্ডিতবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিহারের ভাগলপুরে ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, তার মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলের পুরাকীর্তির বিষয়ে সবিস্তারিত জানা যায়।
ভাগলপুর থেকে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই রায় এস.কে রায়, এ.কে মৈত্রেয় এবং আর.পি চন্দ পুরাকীর্তি বিষয়ক একটি সমিতি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাজশাহী শহর সন্নিহিত এলাকা থেকে পুরাকীর্তি সংগ্রহের জন্য একটি অনুসন্ধানী সফর করেন। রামকমল সিংহ এবং রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় কলকাতা থেকে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন এবং এই সফরে তাঁরা ১৩২টি পুরাকীর্তি বস্ত্ত সংগ্রহ করেন। রাখালদাস এই কীর্তিসমূহ কলকাতা জাদুঘরের জন্য এবং রামকমল বেঙ্গল লিটারেরি অ্যাসোসিয়েশনের জন্য নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু আর.পি চন্দ দৃঢ়ভাবে তাঁদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং তাঁকে কুমার এস.কে রায় সমর্থন করেন। ফলে একই বছরের (১৯১০) সেপ্টেম্বর মাসে রাজশাহীতে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সোসাইটির সভাপতি হন এস.কে রায়, পরিচালক হন এ.কে মৈত্রেয় এবং সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন আর.পি চন্দ। বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আর.পি চন্দ এটির দাপ্তরিক কাজ, পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী সংগ্রহ করে নিবন্ধন ও সংরক্ষণ করার মতো বিরাট দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। তিনি সমগ্র সংগ্রহকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করেন: প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন ভাস্কর্যের নিদর্শন এবং প্রাচীন বিদ্যা ও ধর্মভিত্তিক নিদর্শন, যা তাঁর দক্ষতা এবং জ্ঞানের পরিধি নির্দেশ করে। এই সংগ্রহ শালার জন্য তাঁর শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান ছাড়াও তাঁকে নিয়মিতভাবে অর্থ দান করতে হতো। পরবর্তীসময়ে এ.কে মৈত্রেয়র প্রস্তাব অনুসারে রায় এস.কে রায় যখন জাদুঘর ভবন তৈরি করছিলেন তখন তিনি তাঁকে উৎসাহ এবং সহায়তা প্রদান করেন।
গৌড় রাজমালা (১৯১২) এবং Indo Aryan Races (১৯১৬) বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রমাপ্রসাদ চন্দের পান্ডিত্যের খ্যাতি আরো ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতা আর্কিওলজির মহা পরিচালকের আমন্ত্রণে তিনি গবেষক পদে দুবছর (১৯১৭-১৯) কাজ করেন। তিনি তক্ষশীলা, মথুরা, সারনাথ ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কার এবং খনন কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মধ্য প্রদেশের সাঁচী জাদুঘরে রক্ষিত নিদর্শনসমূহের তিনি যে তালিকা প্রস্ত্তত করেন তা সমসাময়িক পন্ডিতদের প্রশংসা অর্জন করে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ফিরে আসেন এবং বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটিতে কাজ শুরু করেন। স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি হওয়ায় চন্দ স্কুলের চাকরি ছেড়ে দেন এবং কলকাতা চলে যান। কয়েক মাস পর আর.পি চন্দ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রভাষক (Lecturer) হিসেবে যোগ দেন। তাঁর যোগদানের পর পরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয় এবং তাঁকে বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এখানে দুবছর (১৯১৯-২১) চাকরি করার পর তিনি জন মার্শালের অনুরোধে কলকাতা জাদুঘরের কিউরেটর হিসেবে যোগ দেন। ১৯২১ সালের ২৩ মার্চ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাদুঘরের প্রদর্শন কক্ষসমূহ তিনি পুনর্বিন্যাস করেন এবং সংগ্রহশালা আরো সমৃদ্ধ করেন। এছাড়া তিনি জাদুঘর সামগ্রীগুলি শ্রেণীবদ্ধকরণের আধুনিক নিয়ম অনুযায়ী সময় ও যুগ অনুসারে শ্রেণীবদ্ধ করেন। এই বছরগুলিতে তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ লেখেন। জ্ঞানের জগতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৪ সালে সরকার তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব প্রদান করেন। ১৯৩২ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আর.পি চন্দ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বেঙ্গল লিটারেরি অ্যাসোসিয়েশনের কার্য-নির্বাহী সদস্য হিসেবে মূল্যবান অবদান রাখেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং নৃতাত্ত্বিক বিশ্ব সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে ‘Indo Aryan Races’-এর ওপর ভাষণ দেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রাচ্য বিভাগের অধ্যক্ষ আর.এন হবসন জাদুঘরে রক্ষিত ভারতীয় সংগ্রহের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান।
আর.পি চন্দ এই অনুরোধ রক্ষা করেন এবং আর.এল হবসন লিখিত ভূমিকাসহ গ্রন্থটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ সালের মে মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। [সাইফুদ্দীন চৌধুরী]