চক্রবর্তী, মনীন্দ্রলাল
চক্রবর্তী, মনীন্দ্রলাল (১৯১০-১৯৮৩) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা। জন্ম ১৯১০-এর ২০ সেপ্টেম্বর বার্মার (মায়ানমার) মংডু শহরে। পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রামে। বাবা মংডুতে কবিরাজি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাই তাঁর শৈশব কাটে মংডুতে। শিক্ষা জীবনের শুরুতে বালক মনীন্দ্রলাল চলে আসেন বাজালিয়া গ্রামে পৈত্রিক মাটিতে। নিঃসন্তান কাকা কাকিমার কাছে। মেধাবী ছাত্র মনীন্দ্র লাল ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন পটিয়া থানার হাইস্কুলে। দশম শ্রেণীর ছাত্র যখন তখনই তাঁর বিপ্লবে প্রথম হাতেখড়ি। বিপ্লবের প্রথম দীক্ষা দিলেন একই স্কুলের ছাত্র শ্রীপতি নন্দী। তিনি চট্টগ্রাম থেকে এসে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। সে যুগে বিপ্লবী তরুণরা ছিলেন যার যার এলাকায় জনপ্রিয়। নিঃস্বার্থে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমুখী কাজের মধ্যদিয়ে স্কুল কলেজ ও গ্রামে সকলের মন জয় করতে পারতেন। শ্রীপতি নন্দী ছিলেন তেমন জনপ্রিয়। বিপ্লবী হওয়ার সূচনায় নিজেদের তৈরি করতে তখন দুটো প্রাথমিক কাজে যুক্ত থাকতে হতো। প্রথমটি হচ্ছে ভালোভালো বই পড়ে নিজেদের ভেতরে দেশপ্রেমকে স্পষ্ট করা এবং বিপ্লবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্ত্তত হওয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের শারীরিকভাবে যোগ্য করে তোলা। শ্রীপতি নন্দী ছিলেন সে সময়ের গোপন বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতির’ সদস্য। চারদিকে বৃটিশ শাসন বিরোধী চেতনা এবং তাঁর যোগান দেয়া বই পড়ে মনীন্দ্র লাল বিপ্লবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্ত্তত হতে থাকেন। কাজেই শ্রীপতি নন্দী ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্কুলের পর উৎসাহী ছেলেরা সেখানে ব্যায়াম অনুশীলনে একত্রিত হতো। মনীন্দ্রলালও এ দলে যোগ দেন।
এভাবে শারীরিক ও মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণের এক পর্যায়ে শহর থেকে আসা এক বয়োজ্যেষ্ঠ বিপ্লবী বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। নিজ মেধা ও দৃঢ়তার কারণে মনীন্দ্র লাল স্কুলে সমিতি বিস্তারের দায়িত্ব পান। এসময়েই তারা অস্ত্র চালনাসহ নানা রকম বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পরেন।
বিপ্লবী মনীন্দ্র লাল চক্রবর্তী ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে ভর্তি হন। এই পর্বে তিনি নিজেকে অনেক বেশি স্বদেশী ও বিপ্লবী কর্মে যুক্ত করেন। কলেজিয়েট স্কুল, মিউনিসিপ্যাল স্কুল ও পাহাড়তলী স্কুলের গোপন কাজের দায়িত্ব পরে তাঁর ওপর। এই স্কুলের প্রতিনিধিদের সাথে সপ্তাহে একদিন গোপন জায়গায় মিলিত হয়ে নতুন সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করাতেন, বইপত্র বিতরণ করতেন আর আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবীদের জীবনের কাহিনী বলে সকলকে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করতেন।
১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলনে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও যোগদান করেন। এর পুরোভাগে ছিলেন মনীন্দ্রলাল। মাস্টারদা সূর্যসেন এ সময় চট্টগ্রাম কংগ্রেসের সম্পাদক। তখন অনুশীলন সমিতির মত ‘যুগান্তর’ ছিল আরেকটি বিপ্লবী সংগঠন। সূর্যসেন ছিলেন যুগান্তরের সাথে যুক্ত। স্বদেশী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পুলিশি অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে মনীন্দ্র লালসহ অনেক বিপ্লবীকেই আত্মগোপনে থাকতে হয়। তবে বিপ্লবের গতি তাঁরা অনেক বাড়াতে পেরেছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্রগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত হয়। এ সময় প্রচুর ধরপাকড় চলে। বন্দী হন মাস্টার দা। পরে তাঁর ফাঁসি হয়।
মনীন্দ্রলাল চক্রবর্তীকে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়। অবশেষে পারিবারিক সিদ্ধান্তে তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯৩১ সালে কলকাতায় এসে ‘অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ কলেজে’ ভর্তি হন। এখানে হোস্টেলে অবস্থানকালে তিনি আবার বিপ্লবী কর্মকান্ডে নিজেকে যুক্ত করেন। এই হোস্টেলে আরো অনেক বিপ্লবী ছাত্রের অবস্থান ছিল। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের দৃষ্টি পরে হোস্টেলের উপর। ১৯৩৫ সালের ১ এপ্রিল পুলিশ মনীন্দ্রলালকে আটক করে। থানা হাজতে কিছুদিন থাকার পর রাজবন্দী হিসেবে তাঁর জায়গা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। এখানেই দেশের নানা অংশের বিপ্লবীদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। প্রেসিডেন্সি জেলে ৬ মাস কাটাবার পর তাঁকে বদলি করা হয় ময়মনসিংহ জেলার কুলিয়ার চর থানায়। রাজবন্দী হিসেবে এখানে অন্তরীণ থাকেন আড়াই বৎসর। বন্দী জীবনে বইপত্র পড়ার অভিলাষে এসময় তিনি পত্র যোগাযোগ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। কবির সুপারিশে বিশ্বভারতী সহজ কিস্তিতে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের বই কেনার সুযোগ করে দেয়।
আড়াই বছর কুলিয়ার চরে বন্দী জীবন কাটানোর পর ডা. মনীন্দ্রলালকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বার্মায় নিজ বাবা মায়ের কাছে নজরবন্দী হিসেবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশে ফেরার ব্যাপারে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। কিছুকালের মধ্যেই রাজবন্দীদের মুক্তির তালিকায় মনীন্দ্রলালের নাম পাওয়া যায়। তিনি কলকাতায় ফিরে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পাঠ শেষ করেন। অতঃপর বিপ্লবী গৃহী জীবনে ফিরে আসেন। শেষ জীবন তিনি তাঁর হুগলিবাসী ছেলেদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। বিপ্লবী ডা. মনীন্দ্রলাল চক্রবর্তীর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে ১৯৮৩ সালের ১৪ জুলাই ৭৩ বছর বয়সে। [এ.কে.এম শাহনাওয়াজ]