গীতাঞ্জলি

গীতাঞ্জলি  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) রচিত অন্যতম একটি কাব্যগ্রন্থ। বাংলা গীতাঞ্জলি (রচনাকাল, ১৯০৮-১৯০৯) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ The Song Offerings। ইংরেজি ভাষায় গদ্যে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম সংকলনগ্রন্থ। ১৯১২ সালের শেষ দিকে লন্ডনের ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক ১ম ’গীতাঞ্জলি/দি সং অফারিংস’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালের ১০ নভেম্বর গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাংলাসাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এ স্বীকৃতির ফলে রবীন্দ্র কবিপ্রতিভা বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করে। দি সং অফারিংস’ গ্রন্থটির আন্তরিক ও প্রশস্তিপূর্ণ ভূমিকা লিখেছেন খ্যাতনামা আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস্ (উইলিয়ম বাটলার ইয়েটস)। ভুমিকার পাশাপাশি তিনি রথেনস্টেইন অঙ্কিত কবির একটি পেন্সিল স্কেচও সংযোজন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি/দি সং অফারিংস  গ্রন্থটি তাঁকেই উৎসর্গ করেন।

দি সং অফারিংস রচনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-১৯১২ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথের জাহাজযোগে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। যাত্রার পূর্বে তিনি অর্শরোগের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তিনি পদ্মা নদীতে নৌকায় বিশ্রাম নিতে শুরু করেন। মূলত: এসময় তিনি তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইরেজিতে গীতাঞ্জলি/দি সং অফারিংস কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ শুরু করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নৈবেদ্য, উৎসর্গ, খেয়া ও গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন-‘আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সেই মহামানবের মধ্যে যিনি সদা জনানাং হূদয়ের সন্নিবিষ্টঃ আমি আবাল্য অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গন্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্থাৎ আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি-তাতে বাইরে থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং গীতাঞ্জলির সবকটি কবিতা/গানগুলোর অনুবাদ করেননি। উক্ত গ্রন্থটির অনুবাদ কর্মের সঙ্গে আরো আছেন ব্রাদার্স জেমস এবং ব্রিটিশ কবি ও অনুবাদক জো উইন্টার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ অনুবাদে স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন। আক্ষরিক অনুবাদ তো নয়ই বরং ভাবানুবাদেরও বেশি। মাঝে মাঝে কবিতাংশ সংক্ষিপ্ত করেছেন, কখনো বা ভাবার্থ করেছেন। কেবল কবিতাগুলোর ভাববস্ত্তকে অক্ষত রেখেছেন। এই অনুবাদ কর্মটির কারণে পাশ্চাত্য সাহিত্যসহ বিশ্ব সাহিত্যে বাংলাভাষা সম্পর্কে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। ফলে রবীন্দ্র-কবিপ্রতিভা বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন করে।

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানে সুইডিশ একাডেমি তাদের বক্তব্যে জানান-রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তাঁর গভীর সংবেদনশীল, সতেজ ও সুন্দর কবিতার জন্য, যার সাহায্যে পরম নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি তাঁর স্বকৃত ইংরেজি ভাষান্তরের মাধ্যমে তাঁর কাব্যিক চিন্তাচেতনাকে পশ্চিমা সাহিত্যের একটি অংশে পরিণত করেছেন।

গীতাঞ্জলি/দ্য সং অফারিংস-এ ১০৩টি কবিতা/গান স্থান পেয়েছে। বাংলা গীতাঞ্জলি কাব্যের ১৭৫টি কবিতা/গান থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ৫৩টি কবিতা/গানকে স্থান দিয়েছেন। অবশিষ্ট ৫০টি কবিতা/গান নিয়েছেন ৯টি কাব্যগ্রন্থ থেকে, যেমন-গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালি থেকে ১টি, উৎসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন নাটক থেকে ১টি। গীতিমাল্য কাব্যটি কবির পরিণত জীবনে সঙ্গীতের পবিত্র মাল্য। কাব্যটিতে কবি ঈশ্বরের কাছে নানাভাবে নানামূর্তিতে নিবেদন প্রকাশ করেছেন; নৈবেদ্য কাব্যের ‘চিত্ত যেথা ভয়-শূন্য’ কবিতায় কবি চিত্তের ঔদার্য, নির্ভিকতা এবং জ্ঞানের যুক্তির কথা বলেছেন; অচলায়তন নাটকের বক্তব্য-অচলায়তনের রুদ্ধগৃহে যে জ্ঞান সংগৃহীত হয় সে নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ বলেই প্রাণহীন এবং নিঃস্ব। কিন্তু চতুর্দিকের দেয়াল যখন ভেঙে যায় এবং বাইরের আনন্দ চিত্তে প্রবেশ করে, জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা তখনই সার্থক হয়। পঞ্চক হচ্ছে নিয়ম ও স্বাধীনতার প্রতীক আর মহাপঞ্চক বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রতীক। অচলায়তন নাটকের আলো আমার আলো-গানের মাধ্যমে রবি কিরণের সঙ্গে প্রকৃতির আশীর্বাদকে জাগ্রত করেছেন জীবন-যৌবন-ভূবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সেখানে অন্ধকারের বিপরীত স্রোতে হূদয়ের স্পন্দন বীণার ঝংকারের মাধ্যমে কবি তুলে ধরেছেন।  [শামীমা আক্তার]