গাজীর গান
গাজীর গান গাজী পীরের বন্দনা ও মাহাত্ম্য গীতি। প্রধানত ফরিদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে এ গান এক সময় প্রচলিত ছিল। সন্তান লাভ, রোগব্যাধির উপশম, অধিক ফসল উৎপাদন, গো-জাতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এরূপ মনস্কামনা পূরণার্থে গাজীর গানের পালা দেওয়া হতো। এ উপলক্ষে আসর বসিয়ে কিছু লৌকিক আচারসহ গাজীর গান পরিবেশিত হতো। আসরে থাকত গাজীর পট, যাতে কারবালার ময়দান, মক্কার কাবাগৃহ, কাশীর মন্দির ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহ অঙ্কিত হতো। অনেক সময় এসব পট মাটির সরা বা পাতিলেও অাঁকা হতো।
গানের দলে ঢোলক ও বাঁশিবাদক এবং ৪-৫জন দোহার থাকত। দলনেতা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরে একটি আসা দন্ড (magic stick) অবিরাম দুলিয়ে দুলিয়ে এবং লম্বা পা ফেলে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গাইত, আর দোহাররা তা পুনরাবৃত্তি করত; মুহুর্মুহু বাদ্যের তালে তালে এ গান চলত।
মূল গায়েন প্রথমে বন্দনা গাইত: ‘পূবেতে বন্দনা করি পূবের ভানুশ্বর। এদিকে উদয় রে ভানু চৌদিকে পশর\ ...তারপরে বন্দনা করি গাজী দয়াবান। উদ্দেশে জানায় ছালাম হেন্দু মোছলমান\’ এরপর গাজীর জন্মবৃত্তান্ত, দৈত্য-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ, রোগ-মহামারী ও নানা বিপদ-আপদে দুষ্ট আত্মার সঙ্গে যুদ্ধ, অকুল সমুদ্রে ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে পুণ্যবান ভক্ত সওদাগরের নৌকা রক্ষা এসব বর্ণনা করা হতো।
গাজী পীর মুসলমান হলেও অসাম্প্রদায়িক; হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁর ভক্ত। গাজীর গানে সমাজের বিভিন্ন আচার-বিচার ও সমস্যা তুলে ধরা হতো। কোনো কোনো গানে দুগ্ধ-দধি ব্যবসায়ী গোয়ালার ঘরে দুগ্ধ থাকা সত্ত্বেও গাজীকে না দেওয়ায় তার শাস্তি বর্ণিত হতো। অপর একটি গানে আছে, গাজী পীর জমিদারের অত্যাচার থেকে প্রজা সাধারণকে রক্ষা করেছেন; এমনকি মামলা-মকদ্দমায় জয়ী হওয়ার আশ্বাসও আছে একটি গানে: ‘গাজী বলে মোকদ্দমা ফতে হয়ে যাবে। তামাম বান্দারা মোর শান্তিতে থাকিবে\’ এরূপ গানে ধর্মীয় ও বৈষয়িক ভাবনা একাকার হয়ে গেছে। গান চলার সময় আসরে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা তাদের মানতের টাকা-পয়সা গাজীর উদ্দেশ্য দান করে থাকে। বর্তমানে এ গানের প্রচলন নেই বললেই চলে। [আশরাফ সিদ্দিকী]