খেরুর মসজিদ
খেরুর মসজিদ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার অন্তর্গত খেরুর গ্রামের উত্তর পূর্ব কোণে দু একর বিস্তৃত এবং আনুমানিক তিন মিটার উচু একটি টিলার উপর অবস্থিত। এটি হোসেন শাহী আমলে নির্মিত। গ্রামটি বিভিন্ন নামে যথা খেরুর, খেরুল অথবা খেরাউল নামে অভিহিত এবং বেরহামপুর ও ফারাক্কার মধ্যবর্তী শেকের দিঘির প্রায় ৫ কিমি দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত।
বর্তমানে মসজিদে লাগানো দুটি উৎসর্গকৃত আরবি শিলালিপি, যার একটিতে শাসনরত সুলতানের নাম আছে, কিন্তু অন্যটিতে নেই, তথ্যানুযায়ী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ-এর শাসনামলে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি.) জনৈক রাফাত খান ৯০০ হিজরিতে (১৪৯৩-৯৫ খ্রি.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন।
আচ্ছাদিত আয়তাকৃতির কাঠামোর মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে ইটের তৈরী এবং এতে পাথরের কোনো আবরণ নেই। চার কোণার চারটি মিনারসহ এ মসজিদদে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রার্থনা কক্ষ এবং তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বারান্দা আছে। যাহোক, পাথরের টুকরাসমূহ, যা সম্ভবত পূর্বেকার কোনো কাঠামো হতে সংগ্রহ করা হয়েছিল তা বারন্দা ও প্রার্থনা কক্ষে সরদল, স্তম্ভ ও পোস্তায় ব্যবহার করা হয়েছে। মূল প্রার্থনা কক্ষের গোলাকার গম্বুজটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধসে যায়। কিন্তু সামনের বারান্দার তিনটি গম্বুজ মোটামুটিভাবে অক্ষত আছে। উত্তর-পশ্চিম কোণের মিনারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য তিনটি মিনার কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত ও অবচ্ছেদিত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে।
মূল প্রার্থনা কক্ষ অভিমুখী স্তম্ভাবলম্বিত বারান্দার তিনটি খিলানপথের মধ্য দিয়ে পূর্ব দিক থেকে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়। প্রার্থনা কক্ষটি পরিমাপে দৈর্ঘ ও প্রস্থে প্রায় নয় মিটার। বারান্দা ও প্রার্থনা কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি অতিরিক্ত প্রবেশ পথ আছে। কিবলা দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তকার কুলুঙ্গি। এর মধ্যে মাঝেরটি অন্য দুটি অপেক্ষা বড়। দক্ষিণ দিকের মিহরাবটি ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। কিন্তু মাঝের ও উত্তর দিকের মিহরাব দুটি নষ্ট হয়ে গেছে। মসজিদের অলংকরণ পরিকল্পনা, যার জন্য এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বাস্তবায়িত করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে ইট দিয়ে। শুদু ব্যতিক্রম হলো আটটি পোস্তা। এগুলি পাথরের তৈরী।
মসজিদটি প্রাক-মুগল মসজিদের বর্গাকার গম্বুজরীতির মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। এ মসজিদের সম্মুখে একটি বারান্দা আছে। এ রীতি বাংলা সালতানাতের পরবর্তী ইলিয়াস শাহী শাসনামলে বিকাশ লাভ করেছে এবং এর উদাহরণ দেখা যায় গৌড়ের চামকাটি মসজিদ, লট্টন মসজিদ ও রাজবিবি মসজিদ; দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ মসজিদ, সুরা মসজিদ ও রুকন খান মসজিদ; বাগেরহাটের মসজিদবাড়ি মসজিদ ইত্যাদিতে।
কিবলা দেওয়ালটি ইট রেলিফ নকশায় অতিসুন্দর ও মনোরমভাবে অলঙ্কৃত। এ ধরনের অলঙ্করণ গৌড়ের ধুনিচক মসজিদের অলংকরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পশ্চিমদিকের বাইরের দেওয়ালে তিনটি অনুভূমিক আলঙ্কারিক বন্ধনী রয়েছে। এর নিম্নাংশে আছে জটিল নকশা এবং উপরাংশে রয়েছে চমৎকার খোপ নকশা। অনুরূপ পোড়ামাটির খোপনকশা উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের অভ্যন্তরে এবং ফাসাদের বাম পার্শ্বে এখনও বিদ্যমান। বক্রাকারে ইটের কারুকার্যের নিদর্শনসমূহ বাইরের অন্যান্য দেওয়ালের চারদিকে অল্প করে দেখা যায়। অলঙ্করণ পরিকল্পনায় প্রধানত ফুলেল নকশা দেখা যায় এবং এর মধ্যে গোলাপ প্রাধান্য পেয়েছে।
মসজিদের নিকটে গাজী পীর কল্লার সমাধির ইটের সমতল ছাদের নিচে পড়ে থাকা মসজিদের দুটি উৎসর্গকৃত আরবি শিলালিপি পাওয়া গেছে। শিলালিপি দুটি পেয়েছিলেন টি. ব্লক (১৯০৫)। পরবর্তীকালে সংরক্ষণ কাজের সময়ে শিলালিপি দুটিকে ফাসাদে লাগানো হয়। মসজিদটি ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের আওতায় একটি সংরক্ষিত নিদর্শন।
১৯৯২ সালে টিলাটির চারপাশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হয় এবং কাছের একটি পুকুরের উত্তর পাড় খনন করা হয়। এর ফলে কালো রঙের মাটির পাত্রাদির ভাঙ্গা টুকরা এবং লাল রঙের পণ্য সামগ্রীসমূহ, ধূসর ও বাদামি পণ্য, লৌহ খন্ড, ছোট ছোট পাথর খন্ড, গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী যুগের ইট (৪র্থ-৭ম শতক), পাল আমলের কালো পাথরের আয়তাকার চৌহদ্দি নির্দেশক (মার্কার) পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ১৯৭৮ সালে এ গ্রামে পাল-সেন যুগের কালো পাথরের বিষ্ণুর মূর্তি পাওয়া গেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ একথারই ইঙ্গিদ দেয় যে, আদি ঐতিহাসিকাল থেকেই এ এলাকায় ধারাবাহিকভাবে কম বেশি মানুষের বসবাস ছিল। [প্রতীপ কুমার মিত্র]
গ্রন্থপঞ্জি AH Dani, Muslim Architecture in Bengal, Dacca, 1961; বিজয় কুমার বন্দোপাধ্যায় ও অমিয় কুমার বন্দোপাধ্যায়, পশ্চিম বঙ্গের পুরাসম্পদ মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, ১৯৮২; Catherine B Asher, ‘Inventory of key monuments’ in George Michell (ed), The Islamic Heritage of Bengal, UNESCO, Paris, 1984.