খামার ব্যবস্থা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:০৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

খামার ব্যবস্থা (Farming System)  খামারের সার্বিক উৎপাদনের লক্ষ্যে ফসল উৎপাদন, গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ, কৃষি বনায়ন ইত্যাদির জন্য গৃহীত ব্যবস্থাদি। নির্দিষ্ট কিছু প্রাকৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার আওতায় এর লক্ষ্যসমূহ পূরণ এবং অগ্রাধিকারসমূহ বাস্তবায়ণের জন্য কৃষি ব্যবস্থায় খামার, গৃহস্থালী, খামার বহির্ভূত এবং খামার দূরবর্তী উৎপাদন এবং ব্যবহার কার্যকর করার জন্য ভূমি, শ্রম, উপকরণ এবং পূঁজি বা মূলধন ব্যবহারের প্রক্রিয়া এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মিশ্র কৃষি ব্যবস্থায় ফসল উৎপাদন, গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ এবং সম্ভাব্য অন্যান্য উদ্যোগসমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকারের উৎপাদন পদ্ধতি চালু রয়েছে। অধিকাংশ বৃহৎ খামারে একের অধিক উদ্যোগ থাকতে পারে এবং অবস্থার উপর ভিত্তি করে তা হতে পারে পরিপূরক বা সম্পূরক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে কিছু উৎপাদন ব্যবস্থায় রয়েছে ফসল-গবাদি পশু-ছাগল-হাঁস-মুরগি-মৎস্য, ফসল-গবাদি পশু-মহিষ-হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু-ছাগল-হাঁস-মুরগি, ফসল-মৎস্য ইত্যাদি।

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ হওয়ার কারণে এখানে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বেঁচে থাকার জন্য সরাসরি তাদের নিজস্ব খামারের উৎপাদনের উপর নির্ভর করে; দেশটির কৃষিকাজ জটিল, শ্রমঘন, এবং এর প্রযুক্তিগত ও সম্পদের ভিত্তি হচ্ছে নিম্নমানের। এদেশের অধিকাংশ অঞ্চলগুলিতে কৃষি প্রতিবেশগত অবস্থা জটিল। এ দেশের রয়েছে কতগুলি স্বতন্ত্র প্রকারের জমি। যে কোনো গ্রামে কয়েক ধরনের জমি থাকতে পারে এবং এগুলি ভূমির ব্যবহারকে জটিল করে তোলে। মৃত্তিকার অন্তত ২০টি বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যথেষ্ট অমিল রয়েছে। জলবায়ুগত, প্রাকৃতিক, এবং আর্থ-সামাজিক পার্থক্য বা ভিন্নতার পরিণামে অনেক চাষপদ্ধতিতে বিভিন্ন জাতের ফসল, প্রযুক্তি এবং বীজ বপনের সময় বা তারিখ ইত্যাদির তারতম্য ঘটায়। অধিকাংশ খামার এমন ধরনের চাষপদ্ধতি অনুসরণ করে যাতে থাকে ক্রমপর্যায়ে চাষপদ্ধতি (Sequential cropping), মিশ্র চাষপদ্ধতি (Mixed cropping) এবং বদলি ফসল চাষপদ্ধতি (Relay cropping)। ক্রমপর্যায়ে ফসল চাষপদ্ধতি হচ্ছে দুটি ফসল খুব দ্রুত অনুক্রমে লাগানো এবং এ পদ্ধতিতে একটি ফসল তোলার অব্যবহিত পরই অপর ফসলটির চারা লাগানো বা রোপণ করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে মিশ্র ফসল চাষ হচ্ছে একটি যুগপৎ ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা, যেখানে দুটি অথবা তার অধিক ফসল একই জমিতে মিশ্রিত অবস্থায় উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ফসলসমূহের বীজ বপন একই সময়ে হতে পারে আবার নাও হতে পারে। বদলি ফসল চাষ ব্যবস্থায় দুই অথবা তার অধিক ফসল পর্যায় ক্রমিকভাবে উৎপাদন করা হলেও সেখানে পূর্বের ফসলের ফুল আসার পরে কিন্তু ফসল তোলার আগেই পরবর্তীটির বীজ বপন বা চারা লাগাতে হয়।

পাওয়ার টিলারের সাহায্যে জমি চাষ
চারারোপণ
অগভীর নলকূপের সাহায্যে পানিসেচ
ধান কাটার দৃশ্য

বাংলাদেশে খামার ব্যবস্থা প্রণালী গবেষণার সূচনার মূল নিহিত রয়েছে চাষপদ্ধতি গবেষণার ভিতর যেটি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফসলসমূহ এবং/অথবা এসবের জাত অন্তর্ভুক্ত করা বা বাদ দেওয়ার মাধ্যমে এবং ব্যবস্থাপনা অনুশীলনের দক্ষতার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য অধিক উৎপাদনশীলতা সম্পন্ন এবং বেশি লাভজনক কৃষি ব্যবস্থার ধরন উন্নয়নের ক্ষেত্রে চাষপদ্ধতি গবেষণা হচ্ছে একটি সমন্বিত প্রস্তাবনা। বহুক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গবেষক দল এতে অন্তর্ভুক্ত থাকেন গবেষণার রূপরেখা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং খামারে পরিচালিত গবেষণা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার জন্য। এ গবেষণা দলে সাধারণত কৃষিবিদ, কৃষি র্অথনীতিবিদ এবং বালাই ব্যবস্থাপনা কাজে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিসহ বিশেষজ্ঞগণ অন্তর্ভুক্ত থাকেন। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক শুরু করা চাষপদ্ধতি গবেষণা ধানকে কেন্দ্র করে চলমান রয়েছে। বর্তমানে এশিয়ান ফার্মিং সিস্টেমস্ নেটওয়ার্ক রূপে পুনর্বিন্যাসকৃত এশিয়ান ক্রপিং সিস্টেমস্ নেটওয়ার্কে অংশ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক উদ্ভাবিত পদ্ধতি আরও উন্নত এবং পরিমার্জিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একেবারে শুরু থেকেই এশিয়ান ক্রপিং সিস্টেমস নেটওয়ার্কের সদস্য মনোনীত হয়েছিল এবং ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে চাষপদ্ধতি গবেষণায় ধান ভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে।

১৯৮০ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ জাতীয় সমন্বিত চাষপদ্ধতি গবেষণা কর্মসূচির সূচনা করেছিল নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যসমূহ সাধনের লক্ষ্য নিয়ে: ১. মাথাপিছু উচ্চতর মাত্রায় খাদ্য গ্রহণের জন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এবং বর্ধিত পরিমাণে খাদ্যশস্য, তৈলবীজসমূহ, শাকসবজি ইত্যাদি উৎপাদনের মাধ্যমে সুষম খাদ্যের যোগান এবং ২. আয় বৃদ্ধি এবং আয়বর্ধক কার্যক্রম বৃদ্ধিতে এবং তার মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে সহায়তা করা। ছয়টি জাতীয় সংস্থা (সংগঠন) এবং একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিল।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক একটি কারিগরী কর্মীদল গঠন করা হয়েছিল যেটি চলমান কর্মসূচি জরিপ এবং পর্যালোচনা করেছিল। সমন্বিত কার্যসূচির সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং একটি বেসরকারি সংগঠন মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (MCC)। কর্মসূচিটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল একটি নির্বাচিত ক্ষেত্রে ফসল ফলানোর পদ্ধতির উপর সমীক্ষা চালানো এবং খামারিদের সম্পদসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তিসমূহ চিহ্নিত করা এবং এর পাশাপাশি বৃষ্টির পানিতে চাষ এবং সেচ সুবিধা সম্বলিত অবস্থায় সম্ভাব্য নতুন প্রযুক্তিসমূহের প্রচলন করা। এ কর্মসূচিতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি ছিল এশিয়ান ক্রপিং সিস্টেমস্ নেটওয়ার্কের অনুরূপ পদ্ধতি যেটি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ কর্তৃক কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছিল। এ পদ্ধতির ক্রমপর্যায় বা অনুক্রমের ছয়টি সুস্পষ্ট ধাপ রয়েছে, যেগুলি হচ্ছে ১. জমি নির্বাচন, ২. জমির ধরন ও বিবরণ, ৩. বিকল্প চাষপদ্ধতির ধরনের রূপরেখা, ৪. বিকল্প চাষপদ্ধতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ৫. প্রাক-উৎপাদন যাচাই ও পরীক্ষামূলক/প্রদর্শনী উৎপাদন কার্যক্রম এবং ৬. উৎপাদন কর্মসূচি বিধিবদ্ধকরণ।

১৯৮৫ সালে উপরোক্ত জাতীয় সমন্বিত চাষপদ্ধতি গবেষণা কর্মসূচি প্রকল্প একটি জাতীয় সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা পদ্ধতি গবেষণা প্রকল্পরূপে পরিব্যাক্ত হয়েছিল যাতে জাতীয় সমন্বিত চাষপদ্ধতি গবেষণা কর্মসূচি প্রকল্প থেকে আহরিত জ্ঞানের ভিত্তিতে এবং অধিকতর বিস্তীর্ণ মাত্রিকতা এবং কার্যক্ষেত্রের পরিধি সংযোজিত হয়েছিল। এর রয়েছে বিস্তৃত লক্ষ্যসমূহ, যেমন ১. মাথাপিছু উচ্চতর মাত্রায় খাদ্যগ্রহণের জন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জনে সহায়তা করা এবং খাদ্যশস্য, তৈলবীজ, নানারকম ডালশস্য, শাকসবজি, মাছ, দুধ, মাংস, ডিম, ইত্যাদি বর্ধিত পরিমাণে উৎপাদনের মাধ্যমে আরও সুষম খাদ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা, ২. দরিদ্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে এবং নারী ও ভূমিহীন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জোর দেওয়া বা গুরুত্ব আরোপ করাসহ শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করা।

পৃথক সাতটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, এবং বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের সমন্বয়ের আওতায় এতে অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলি খামার ব্যবস্থা পদ্ধতির বেশ কিছুসংখ্যক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিল। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে সমগ্র খামার নিয়ে গবেষণার কাজটি প্রথম আরম্ভ করা হয়েছিল ১৯৯০ সালে। খামার ব্যবস্থা গবেষণার স্থান হিসেবে প্রথম ছিল টাঙ্গাইল যেখানে ১৯৯০-১৯৯৩ সালে এ প্রকল্পের কাজ চালানো হয়েছিল।

খামারকে একটি স্বতন্ত্র অবয়ব ধরে নিয়ে সমীক্ষা চালানোর জন্য যখন গবেষণা চালানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে তখন একে বলা হয় খামার ব্যবস্থা গবেষণা (FSR)। এ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত থাকে উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রসমূহ এবং খামারিদের নির্বাচন করা, কারিগরি সমস্যাদি চিহ্নিত করা এবং উৎপাদনের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা, কৃষকদের অবস্থার আলোকে সমস্যাদি সমাধানের জন্য সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করা এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর মাঝে এ সমস্ত গবেষণালব্ধ তথ্যাদি প্রচার করা। এ প্রক্রিয়ায় সরকারি নীতিমালা উন্নয়নের জন্য সুযোগ এবং উদ্দিষ্ট খামারিদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সহায়তা ব্যবস্থাও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সেজন্য কৃষি গবেষণা ভারসাম্যপূর্ণভাবে কেন্দ্রীভূতকরণের মাধ্যমে খামারের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খামার ব্যবস্থা গবেষণা নিবেদিত, যেন উন্নত প্রযুক্তিসমূহ উদ্ভাবন, পরীক্ষণ এবং গ্রহণকে সহজ করা যেতে পারে।

অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশে খামার ব্যবস্থা গবেষণার দৃষ্টিতে সমগ্র খামারকে একটি উৎপাদন ইউনিট এবং গৃহকে একটি ব্যবহার ইউনিট হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কৃষি গবেষকগণ মনে করেন যে, খামারিদের সম্পদের উপর বেশি জোর দিতে হবে, যেন যে কোনো উন্নত প্রযুক্তি তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়। এ ছাড়া একটি উন্নত খামার ব্যবস্থায় পৌঁছার জন্য খামারের সম্পদের সদ্ব্যবহার করার কাজটি উৎপাদন প্রযুক্তির সাথে একত্রে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

[মোঃ সিরাজুল ইসলাম]

খামার যন্ত্রীকরণ (Farm mechanisation)  পশুশক্তি, ইঞ্জিনচালিত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম অথবা অন্যতর যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার কৃষির উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা ও উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদনের খরচ কমায়। বাংলাদেশে কৃষিকার্যের বেশির ভাগ কর্মকান্ডই সাবেকি হস্তচালিত অথবা পশুশক্তিচালিত সরঞ্জাম দ্বারা সম্পন্ন হয় যেগুলিকে যন্ত্রীকরণের কোনো স্তরেই শ্রেণিভুক্ত করা চলে না। যন্ত্রীকরণ প্রধানত সেচপ্রযুক্তিতেই লক্ষ্য করা যায়, যেখানে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরবরাহের জন্য অল্পগভীর স্তর থেকে পানি তোলার পাম্প, অগভীর নলকূপ ও গভীর নলকূপ ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে যন্ত্রীকরণ অত্যন্ত ফলপ্রসূ তা হলো ধান প্রসেসিং শিল্প যেখানে যান্ত্রিক সরঞ্জাম কায়িক শ্রমনির্ভর ধানভানা ব্যবস্থার স্থান প্রায় দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশে কৃষিকর্ম যন্ত্রীকরণের সার্বিক অবস্থা নিচের অনুচ্ছেদগুলিতে বর্ণিত হয়েছে।

জমি প্রস্ত্ততকরণ  বীজবপন বা চারারোপণের জন্য জমিচাষ, ঢেলা ভাঙ্গা এবং মই দিয়ে জমি সমান করা ফসল চাষের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার্যত বাংলাদেশে জমিচাষ চিরাচরিত বলদ-টানা লাঙ্গলেই করা হয়ে থাকে। পরবর্তী কাজের মধ্যে মাটির ঢেলা ভাঙ্গা ও জমি সমান করার জন্য বলদ-টানা অথবা হস্তচালিত সরঞ্জাম ব্যবহূত হয়। জমি প্রস্ত্ততকরণের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় হালের বলদ এবং আমদানিকৃত পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর। প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ ভারবাহী গবাদি পশু কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। নানা জাতের অত্যাধুনিক ফসল আবাদের জন্য অতি সম্প্রতি জমি প্রস্ত্ততকরণে পাওয়ার টিলারের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে লক্ষাধিক পাওয়ার টিলার ব্যবহূত হচ্ছে।

সেচকার্য  বাংলাদেশে সেচকার্যের অধিকাংশই এখন যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন হয়। অগভীর নলকূপ (STW), অগভীর পাম্প (LLP) এবং গভীর নলকূপের (DTW) সাহায্যে বার্ষিক প্রায় ১৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচকার্য চলে। বাংলাদেশে অগভীর নলকূপ সর্বাধিক জনপ্রিয়। মোট সেচ-এলাকায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান সেচ প্রকল্পগুলির অবদান মাত্র শতকরা আট ভাগ। সেচের আওতাধীন প্রকৃত এলাকা শতকরা ত্রিশ ভাগ হতে পারে।

বীজবপন ও চারারোপণ  প্রাচীনকাল থেকে প্রধান ফসলের (আমন ধান) চারারোপণের কাজ প্রধানত হাতে চারা তোলা ও রোপণের চিরাচরিত পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়ে আসছে। গুচ্ছাকারে ধানের চারারোপণ বাংলাদেশের একটি পরিচিত দৃশ্য। অতিসম্প্রতি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে হস্তচালিত চারারোপণ যন্ত্রের প্রচলন শুরু হয়েছে। গম, ভুট্টা, ডাল ইত্যাদির মতো অন্যান্য দানাশস্যের চাষ শুষ্ক বপন পদ্ধতিতেই হয়। ওষধি, গুল্ম ও বৃক্ষাদি অবশ্য সর্বদাই হাতে লাগাতে হয়।

আগাছা নিয়ন্ত্রণ  আগাছা নিয়ন্ত্রণ এখনও হস্তচালিত দেশিয় যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিচু জমিতে সারিবদ্ধভাবে রোপিত ধানক্ষেতে হাতে টানা ঘূর্ণমান ধরনের আগাছা উপড়ানোর যন্ত্র ব্যবহূত হচ্ছে।

ফসল সংরক্ষণ  উদ্ভিদ সংরক্ষণের জন্য কীটনাশক প্রয়োগে প্রধানত পিঠে বহনযোগ্য স্প্রেয়ার ব্যবহূত হয়। ২০০৫ সালে ব্যবহূত কীটনাশকের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫,৪৬৬ মে টন। এর অধিকাংশই ব্যবহূত হয়েছিল ধানের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে।

ফসল কাটা ও শস্য মাড়াই  কাস্তের সাহায্যে ফসল কাটার রীতি যুগ যুগ ধরে কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত। তবে অতি সম্প্রতি শক্তিচালিত ধান-কাটা যন্ত্রের প্রচলন শুরু হয়েছে। ড্রামের উপর হাত দিয়ে আছড়ানো এবং পশু দিয়ে ধান মাড়াই প্রচলিত পদ্ধতি, যদিও পা-চালিত মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার দেশের কোনো কোনো অংশে বেশ প্রচলিত। ইদানিং ধীরে ধীরে শক্তিচালিত মাড়াই যন্ত্রেরও প্রচলন হচ্ছে।

শুকানো ও গুদামজাতকরণ  বাংলাদেশে রোদে বাড়ির উঠানে, খোলা মাঠে বা কখনও কখনও সড়কের উপর বিছিয়ে শস্য শুকানোই চিরাচরিত রেওয়াজ। তবে ব্যক্তি মালিকানায় কেউ কেউ কিছু ধানভানা কল ও বর্ষা মৌসুমে শস্য শুকানো যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে। কৃষকরা সাধারণত চটের বস্তা, ডোল, গোলা, কুঠি প্রভৃতিতে ধান বা চাল সঞ্চিত রাখে।

প্রসেসিং  ধান প্রসেসিং শিল্প বাংলাদেশের এক বৃহত্তম শিল্প। এদেশে প্রতি বছর উৎপন্ন ২ কোটি ৭৮ লক্ষ মে টনের বেশি ধানের প্রায় ৮০-৯০% বা ততোধিক বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ইঈলবার্গ হলারের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে, যেগুলির আনুমানিক কার্য ক্ষমতা ঘণ্টা প্রতি ০.৫-২ মে টন। ইঙ্গলবার্গ মিল চালু হওয়ার আগে মোট উৎপন্ন শস্য (বার্ষিক প্রায় ১ কোটি মে টন) গ্রামীণ কায়িক শ্রমে সাবেকি ঢেকি ও গাইলের সাহায্যে ভানা হতো। ব্যাপকভাবে ধান ভানার যান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থঘর থেকে ঢেঁকি ও গাইল এখন বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ লক্ষ ইঈলবার্গ ও রাবার বেল্টচালিত প্রায় ৫০০ স্বয়ংক্রিয় ধানকল রয়েছে। [মোঃ আবদুল বাকী]

খামার ব্যবস্থাপনার সমস্যাবলী (Farm management problems)  বাংলাদেশে খামার ব্যবস্থাপনার কাজে অসুবিধা সৃষ্টিকারী বহু সামাজিক ও প্রাকৃতিক সমস্যা রয়েছে। এ ধরনের প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবকাঠামোর পরিবর্তন অপরিকল্পিতভাবে, এমনকি উচ্চফলনশীল জাতের (HYV) ধান চাষের জন্যও অনেকগুলি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ডিএনডি বাঁধ, ঠাকুরগাঁও বাঁধ, মেঘনা-ধনাগোদা প্রভৃতি বাঁধ পানির স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে, পলিসঞ্চয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে এবং বন্যার প্রকোপ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার মাটিতে পুষ্টিদ্রব্যের ভারসাম্যহীনতা বাড়িয়ে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্যই সম্ভবত পানির আর্সেনিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলার জন্য বিকল্প জ্বালানি এবং বাঁধ নির্মাণ ও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে বিচক্ষণ পরিকল্পনা আবশ্যক।

অবিরাম ধানচাষ  আজকাল অধিকাংশ কৃষক একই জমিতে শুধুই ধানচাষ করে। ফলে জমিতে ধানগাছের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিবস্ত্তর পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে এবং তাতে জমিতে পুষ্টিগত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। অধিক মুনাফা অর্জন ও মাটির পুষ্টি শক্তি সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শস্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা।

ভূমি মালিকানা ও গ্রামীণ রাজনীতি  গ্রামীণ রাজনীতি ও বিবাদ সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে, গ্রামসমাজে সৃষ্ট অস্থিরতা খামার ব্যবস্থাপনাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং পরিণামে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। স্বাধীনতার পর নগরায়নের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার দরুণ উন্নততর জীবনযাপনের জন্য বহু লোক শহরাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের চাষযোগ্য জমিজমা অযত্নে পড়ে থাকে, এমনকি পতিত জমিতেও পরিণত হয়। এগুলি ফসল উৎপাদনে সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘুর্ণিঝড়, টর্নোডো, বন্যা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অতিনিম্ন ও অত্যুচ্চ তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার কাজে এবং ফসলের বৃদ্ধি ও উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।

গ্রামে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন  স্বাধীনতার পর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, শিল্পায়ন ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টির সুবাদে গ্রামীণ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নততর হয়েছে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে-পড়া তরুণরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করেছে এবং শিল্পকারখানা ও অন্যান্য স্থানে কাজকর্ম শুরু করেছে। এ অবস্থায় কৃষিকাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবলের অভাব ঘটেছে এবং উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যবস্থাপনা শিক্ষা  শিক্ষাব্যবস্থার নিম্নতর পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা অবহেলিত বা উপেক্ষিত হয়ে থাকে। কৃষিশিক্ষায় খামার ব্যবস্থাপনার একটি পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক।

বীজতলা প্রস্ত্ততকরণ  উপযুক্ত জমি ও সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততা, অনাবৃষ্টি, চাষাবাদে পশুর ঘাটতি ইত্যাদি ধানের বীজতলা প্রস্ত্ততকরণে সমস্যা সৃষ্টি করে। ভাসমান বীজতলার মতো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এ সমস্যাগুলি অতিক্রম করা যায়।

শ্রমিকঘাটতি  আজকাল পেশাপরিবর্তন, স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি, শিল্পকারখানায় অপেক্ষাকৃত ভাল ও কম শ্রমসাধ্য কাজের সুযোগ এবং কর্মোপলক্ষে বিদেশযাত্রার ফলে কৃষিকাজে শ্রমিকের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে কিছু কিছু চাষযোগ্য জমি পতিত পড়ে থাকছে, তাতে জাতীয় আয় হ্রাস পাচ্ছে এবং খামার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। উপকরণ বীজ, সার ও কীটনাশকের মতো উপকরণের অপর্যাপ্ততা ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনার একটি প্রকট সমস্যা। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের অপরিমিত ও অযৌক্তিক ব্যবহারে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ফলে মাটিতে বসবাসকারী অনুজীব এবং অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। উৎপন্ন কৃষিপণ্য গুদামজাতকরণ, সরবরাহ ও বিপণন সুবিধাদি এদেশে এখনও পর্যাপ্ত নয়।

[মোঃ জাহান উল্লাহ চৌধুরী]