খান জাহান সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''খান জাহান সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স '''বাগেরহাট জেলার কথিত ঠাকুর দিঘি’র পাড়ে একটি কৃত্রিম উঁচু ঢিবির উপর অবস্থিত। এটি বাইরের দিকে পূর্ব-পশ্চিমে ৬৭.১ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৪.৭ মিটার দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। ‘খান জাহানের দরগাহ কমপ্লেক্স’ হিসেবে এটি অধিক পরিচিত। এ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে খান জাহানের বর্গাকার সমাধিসৌধ, খান জাহানের ‘দীউয়ান’ মুহম্মদ তাহির-এর সমাধি, এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং তথাকথিত রান্নাঘর। খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর  ‘দীউয়ান’-এর স্থানটি একটি মধ্যবর্তী দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত।
'''খান জাহান সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স''' বাগেরহাট জেলার কথিত ঠাকুর দিঘি’র পাড়ে একটি কৃত্রিম উঁচু ঢিবির উপর অবস্থিত। এটি বাইরের দিকে পূর্ব-পশ্চিমে ৬৭.১ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৪.৭ মিটার দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। ‘খান জাহানের দরগাহ কমপ্লেক্স’ হিসেবে এটি অধিক পরিচিত। এ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে খান জাহানের বর্গাকার সমাধিসৌধ, খান জাহানের ‘দীউয়ান’ মুহম্মদ তাহির-এর সমাধি, এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং তথাকথিত রান্নাঘর। খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর  ‘দীউয়ান’-এর স্থানটি একটি মধ্যবর্তী দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত।


'''খান জাহানের সমাধিসৌধ'''  বাইরের দিকে ১৩.৭ মিটার ও ভেতরের দিকে ৯.১ মিটার বিস্তৃত ইটের তৈরি বর্গাকার ভবন, যা কমপ্লেক্সের মূল অংশ গড়ে তুলেছে। এটি বাইরের চারকোণা শক্ত গোলাকার টাওয়ার দ্বারা সুগঠিত। সমাধিসৌধের চারদিকের দেয়াল ২.৪ মিটার পুরু যা ০.৯ মিটার পর্যন্ত পাথর দ্বারা আবৃত। নিঃসন্দেহে এটি ছিল নিচের আর্দ্রতা থেকে ভবনকে রক্ষা করার একটি কৌশল। আর আর্দ্র জলবায়ু ছিল দক্ষিণ বাংলার অতি সাধারণ চিত্র।
[[Image:KhanJahanAliTomb.jpg|thumb|400px|right|খান জাহানের সমাধিসৌধ, বাগেরহাট]]
''খান জাহানের সমাধিসৌধ''  বাইরের দিকে ১৩.৭ মিটার ও ভেতরের দিকে ৯.১ মিটার বিস্তৃত ইটের তৈরি বর্গাকার ভবন, যা কমপ্লেক্সের মূল অংশ গড়ে তুলেছে। এটি বাইরের চারকোণা শক্ত গোলাকার টাওয়ার দ্বারা সুগঠিত। সমাধিসৌধের চারদিকের দেয়াল ২.৪ মিটার পুরু যা ০.৯ মিটার পর্যন্ত পাথর দ্বারা আবৃত। নিঃসন্দেহে এটি ছিল নিচের আর্দ্রতা থেকে ভবনকে রক্ষা করার একটি কৌশল। আর আর্দ্র জলবায়ু ছিল দক্ষিণ বাংলার অতি সাধারণ চিত্র।


সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ছিল মূলত পাথরের ‘লিনটাল’ বা সরদলসম্পন্ন চারটি খিলানপথ। কিন্তু বর্তমানে উত্তর পাশের প্রবেশপথটি ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌধটি ভেতরের দিকে ইটের নির্মিত গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত। এ গম্বুজ দেয়ালের ভেতরে পাথরের ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কোণের টাওয়ারগুলিতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ বৈশিষ্ট্য, যা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্যরীতির পরিচয় বহন করে। খান জাহানের পাথরের কবরটি সমাধিসৌধের মাঝখানে অবস্থিত। এটি উপরের দিকে চারস্তরবিশিষ্ট ও সাধারণ কৌণিক পিপা আকৃতিতে চমৎকার নকশা করা। পাথর দ্বারা নির্মিত উপরের তিনটি স্তরে ধর্মীয় প্রকাশ হিসেবে আরবি ও ফারসি লেখা দ্বারা আবৃত। তবে লেখাগুলির অধিকাংশই বর্তমানে অস্পষ্ট।  
সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ছিল মূলত পাথরের ‘লিনটাল’ বা সরদলসম্পন্ন চারটি খিলানপথ। কিন্তু বর্তমানে উত্তর পাশের প্রবেশপথটি ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌধটি ভেতরের দিকে ইটের নির্মিত গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত। এ গম্বুজ দেয়ালের ভেতরে পাথরের ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কোণের টাওয়ারগুলিতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ বৈশিষ্ট্য, যা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্যরীতির পরিচয় বহন করে। খান জাহানের পাথরের কবরটি সমাধিসৌধের মাঝখানে অবস্থিত। এটি উপরের দিকে চারস্তরবিশিষ্ট ও সাধারণ কৌণিক পিপা আকৃতিতে চমৎকার নকশা করা। পাথর দ্বারা নির্মিত উপরের তিনটি স্তরে ধর্মীয় প্রকাশ হিসেবে আরবি ও ফারসি লেখা দ্বারা আবৃত। তবে লেখাগুলির অধিকাংশই বর্তমানে অস্পষ্ট।  
[[Image:KhanJahanAliTomb.jpg|thumb|400px|right|খান জাহানের সমাধিসৌধ, বাগেরহাট]]


কবরের নিচের দুটি স্তর ইটের তৈরী। এ ইটগুলি ভেতরের সম্পূর্ণ মেঝে বহু বর্ণের বর্গাকার ও ষড়ভুজী টালির নকশা দ্বারা সমৃদ্ধ। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো দর্শনার্থীদের অনবরত ব্যবহারের ফলে টালিগুলির উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে।
কবরের নিচের দুটি স্তর ইটের তৈরী। এ ইটগুলি ভেতরের সম্পূর্ণ মেঝে বহু বর্ণের বর্গাকার ও ষড়ভুজী টালির নকশা দ্বারা সমৃদ্ধ। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো দর্শনার্থীদের অনবরত ব্যবহারের ফলে টালিগুলির উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে।
১৪ নং লাইন: ১৩ নং লাইন:
ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের নিয়মিত সংস্কার কাজের ফলে ভবনটি আজও সুরক্ষিত রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো বর্গাকার পরিকল্পনা, খিলান এবং সরদলে ফিরুজশাহী স্থাপত্যের সমন্বয়, বক্র কার্নিশ, ঘোরানো ব্যান্ড দ্বারা বিভক্ত কর্ণার টাওয়ার এবং গম্বুজের ভারবহনের জন্য নির্মিত স্কুইঞ্চ ইত্যাদি। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই একে হজরত পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধের মতো মনে হয়। তবে একলাখী ভবনটি ছিল অভ্যন্তরে অষ্টভুজী আর খান জাহানের সমাধিসৌধটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকেই চতুর্ভুজ আকৃতির। একক গম্বুজ সমৃদ্ধ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের নির্মাণ ধারার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে অষ্টভুজী কর্ণার টাওয়ার পরিলক্ষিত হলেও খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর অন্যান্য স্থাপত্যগুলিতে গোলাকার কর্ণার টাওয়ার দেখা যায়। তাঁর সমাধিসৌধে গোলাকৃতির কর্ণার টাওয়ার, দেয়ালের খালি গাত্রদেশ এবং খিলান ও সরদলের অপূর্ব সমন্বয় দিল্লির তুগলক স্থাপত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ তুগলকীয় উপাদানের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো পন্ডিত খান জাহানের স্থাপত্য দিল্লির স্থাপত্য থেকে উদ্ভূত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে [[ফিরুজশাহ তুগলক|ফিরুজ শাহ তুগলক]] এর বাংলা অভিযানের সময় আগত এবং ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর কর্তৃক দিল্লি ধ্বংসের কারণে এ অঞ্চলে এসে অভিবাসন স্থাপনকারী কারিগররাই বাংলার স্থাপত্যে তুগলকীয় উপাদানের সূচনা ঘটায়।
ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের নিয়মিত সংস্কার কাজের ফলে ভবনটি আজও সুরক্ষিত রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো বর্গাকার পরিকল্পনা, খিলান এবং সরদলে ফিরুজশাহী স্থাপত্যের সমন্বয়, বক্র কার্নিশ, ঘোরানো ব্যান্ড দ্বারা বিভক্ত কর্ণার টাওয়ার এবং গম্বুজের ভারবহনের জন্য নির্মিত স্কুইঞ্চ ইত্যাদি। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই একে হজরত পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধের মতো মনে হয়। তবে একলাখী ভবনটি ছিল অভ্যন্তরে অষ্টভুজী আর খান জাহানের সমাধিসৌধটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকেই চতুর্ভুজ আকৃতির। একক গম্বুজ সমৃদ্ধ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের নির্মাণ ধারার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে অষ্টভুজী কর্ণার টাওয়ার পরিলক্ষিত হলেও খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর অন্যান্য স্থাপত্যগুলিতে গোলাকার কর্ণার টাওয়ার দেখা যায়। তাঁর সমাধিসৌধে গোলাকৃতির কর্ণার টাওয়ার, দেয়ালের খালি গাত্রদেশ এবং খিলান ও সরদলের অপূর্ব সমন্বয় দিল্লির তুগলক স্থাপত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ তুগলকীয় উপাদানের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো পন্ডিত খান জাহানের স্থাপত্য দিল্লির স্থাপত্য থেকে উদ্ভূত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে [[ফিরুজশাহ তুগলক|ফিরুজ শাহ তুগলক]] এর বাংলা অভিযানের সময় আগত এবং ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর কর্তৃক দিল্লি ধ্বংসের কারণে এ অঞ্চলে এসে অভিবাসন স্থাপনকারী কারিগররাই বাংলার স্থাপত্যে তুগলকীয় উপাদানের সূচনা ঘটায়।


'''মুহম্মদ তাহিরের সমাধি''' খান জাহানের সমাধি সৌধের সামান্য পশ্চিমে অবস্থিত। এটি তিন স্তরবিশিষ্ট একটি পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের মতো। উপরের স্তরে খোদিত একটি লিপি থেকে জানা যায় যে, মুহম্মদ তাহের ৮৬৩ হিজরির জিলহজ মাসে (১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় জনশ্রুতি নির্দেশ করে যে, তাহির ছিলেন খান জাহান আলীর প্রিয় একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। খান জাহানের সমাধির পাশে তাঁর সমাধিসৌধের অবস্থান এ বিশ্বাসকেই জোরদার করে।
''মুহম্মদ তাহিরের সমাধি'' খান জাহানের সমাধি সৌধের সামান্য পশ্চিমে অবস্থিত। এটি তিন স্তরবিশিষ্ট একটি পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের মতো। উপরের স্তরে খোদিত একটি লিপি থেকে জানা যায় যে, মুহম্মদ তাহের ৮৬৩ হিজরির জিলহজ মাসে (১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় জনশ্রুতি নির্দেশ করে যে, তাহির ছিলেন খান জাহান আলীর প্রিয় একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। খান জাহানের সমাধির পাশে তাঁর সমাধিসৌধের অবস্থান এ বিশ্বাসকেই জোরদার করে।


'''মসজিদ'''  এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি কমপ্লেক্স-এর সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত। এটি বর্গাকার পরিকল্পনায় ইট দ্বারা নির্মিত একটি মসজিদ। এর উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব পাশে তিনটি খিলানপথ রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের খিলান দরজাগুলি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরের দিকে কিবলা দেয়ালের সাথে রয়েছে একটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। এর অবস্থান ঠিক পূর্বদিকে খিলানপথ বরাবর। মসজিদটির বাইরের চারপাশে রয়েছে চারটি গোলাকার কর্নার টাওয়ার এবং বক্র কার্নিশ। গোলার্ধ আকৃতির ইটের গম্বুজ বর্গাকার কক্ষটিকে আবৃত করেছে। এটি পাথরের নির্মিত ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চকে স্পর্শ করেছে। নির্মাণ পরিকল্পনা ও গঠনশৈলীর দিক থেকে এটি খান জাহানের সমাধির অনুরূপ। এদিক থেকে বলা যায় যে, সম্ভবত খান জাহানের সমাধিসৌধ নির্মাণকালে অর্থাৎ পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে এ মসজিদটিও নির্মিত হয়।
''মসজিদ''  এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি কমপ্লেক্স-এর সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত। এটি বর্গাকার পরিকল্পনায় ইট দ্বারা নির্মিত একটি মসজিদ। এর উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব পাশে তিনটি খিলানপথ রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের খিলান দরজাগুলি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরের দিকে কিবলা দেয়ালের সাথে রয়েছে একটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। এর অবস্থান ঠিক পূর্বদিকে খিলানপথ বরাবর। মসজিদটির বাইরের চারপাশে রয়েছে চারটি গোলাকার কর্নার টাওয়ার এবং বক্র কার্নিশ। গোলার্ধ আকৃতির ইটের গম্বুজ বর্গাকার কক্ষটিকে আবৃত করেছে। এটি পাথরের নির্মিত ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চকে স্পর্শ করেছে। নির্মাণ পরিকল্পনা ও গঠনশৈলীর দিক থেকে এটি খান জাহানের সমাধির অনুরূপ। এদিক থেকে বলা যায় যে, সম্ভবত খান জাহানের সমাধিসৌধ নির্মাণকালে অর্থাৎ পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে এ মসজিদটিও নির্মিত হয়।


'''তথাকথিত রান্নাঘর''' খানজাহানের সমাধিসৌধ থেকে কয়েক মিটার পূর্বদিকে একটি ভবন ছিল। বর্তমানে এটি মাটির সাথে মিশে গেছে। বিশ শতকের সত্তরের দশকেও এটি সংরক্ষিত ছিল। তবে তখনও এর চার দেয়াল অক্ষত থাকলেও চৌচালা ছাদটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ পাশে ছিল তিনটি খিলানযুক্ত দরজা। এর ভেতরের দিকের পূর্ব দেয়ালে ছিল বেশ কিছু তাক।
''তথাকথিত রান্নাঘর'' খানজাহানের সমাধিসৌধ থেকে কয়েক মিটার পূর্বদিকে একটি ভবন ছিল। বর্তমানে এটি মাটির সাথে মিশে গেছে। বিশ শতকের সত্তরের দশকেও এটি সংরক্ষিত ছিল। তবে তখনও এর চার দেয়াল অক্ষত থাকলেও চৌচালা ছাদটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ পাশে ছিল তিনটি খিলানযুক্ত দরজা। এর ভেতরের দিকের পূর্ব দেয়ালে ছিল বেশ কিছু তাক।


আয়তাকার রান্নাঘরটি ছিল ১২.২ মিটার দীর্ঘ এবং ৫.৮ মিটার চওড়া। এ ভবন মূলত কি উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল তা জানা যায় নি। স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, খান জাহান তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি যেখানে তিনি এখন সমাহিত সেখানে বাস করতেন এবং পার্শ্ববর্তী ভবনটিকে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আনুমানিক এক শতক পূর্বে মসজিদ এবং সমাধিসৌধ তত্ত্বাবধানকারী দুজন ফকির ভবনটিকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।  [এম.এ বারি]
আয়তাকার রান্নাঘরটি ছিল ১২.২ মিটার দীর্ঘ এবং ৫.৮ মিটার চওড়া। এ ভবন মূলত কি উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল তা জানা যায় নি। স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, খান জাহান তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি যেখানে তিনি এখন সমাহিত সেখানে বাস করতেন এবং পার্শ্ববর্তী ভবনটিকে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আনুমানিক এক শতক পূর্বে মসজিদ এবং সমাধিসৌধ তত্ত্বাবধানকারী দুজন ফকির ভবনটিকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।  [এম.এ বারি]


[[en:Khan Jahan’s Tomb, Bagerhat]]
[[en:Khan Jahan’s Tomb, Bagerhat]]

১০:০৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

খান জাহান সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স বাগেরহাট জেলার কথিত ঠাকুর দিঘি’র পাড়ে একটি কৃত্রিম উঁচু ঢিবির উপর অবস্থিত। এটি বাইরের দিকে পূর্ব-পশ্চিমে ৬৭.১ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৪.৭ মিটার দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত। ‘খান জাহানের দরগাহ কমপ্লেক্স’ হিসেবে এটি অধিক পরিচিত। এ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে খান জাহানের বর্গাকার সমাধিসৌধ, খান জাহানের ‘দীউয়ান’ মুহম্মদ তাহির-এর সমাধি, এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ এবং তথাকথিত রান্নাঘর। খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর  ‘দীউয়ান’-এর স্থানটি একটি মধ্যবর্তী দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত।

খান জাহানের সমাধিসৌধ, বাগেরহাট

খান জাহানের সমাধিসৌধ  বাইরের দিকে ১৩.৭ মিটার ও ভেতরের দিকে ৯.১ মিটার বিস্তৃত ইটের তৈরি বর্গাকার ভবন, যা কমপ্লেক্সের মূল অংশ গড়ে তুলেছে। এটি বাইরের চারকোণা শক্ত গোলাকার টাওয়ার দ্বারা সুগঠিত। সমাধিসৌধের চারদিকের দেয়াল ২.৪ মিটার পুরু যা ০.৯ মিটার পর্যন্ত পাথর দ্বারা আবৃত। নিঃসন্দেহে এটি ছিল নিচের আর্দ্রতা থেকে ভবনকে রক্ষা করার একটি কৌশল। আর আর্দ্র জলবায়ু ছিল দক্ষিণ বাংলার অতি সাধারণ চিত্র।

সমাধিসৌধের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ছিল মূলত পাথরের ‘লিনটাল’ বা সরদলসম্পন্ন চারটি খিলানপথ। কিন্তু বর্তমানে উত্তর পাশের প্রবেশপথটি ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৌধটি ভেতরের দিকে ইটের নির্মিত গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত। এ গম্বুজ দেয়ালের ভেতরে পাথরের ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কোণের টাওয়ারগুলিতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ বৈশিষ্ট্য, যা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্যরীতির পরিচয় বহন করে। খান জাহানের পাথরের কবরটি সমাধিসৌধের মাঝখানে অবস্থিত। এটি উপরের দিকে চারস্তরবিশিষ্ট ও সাধারণ কৌণিক পিপা আকৃতিতে চমৎকার নকশা করা। পাথর দ্বারা নির্মিত উপরের তিনটি স্তরে ধর্মীয় প্রকাশ হিসেবে আরবি ও ফারসি লেখা দ্বারা আবৃত। তবে লেখাগুলির অধিকাংশই বর্তমানে অস্পষ্ট।

কবরের নিচের দুটি স্তর ইটের তৈরী। এ ইটগুলি ভেতরের সম্পূর্ণ মেঝে বহু বর্ণের বর্গাকার ও ষড়ভুজী টালির নকশা দ্বারা সমৃদ্ধ। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো দর্শনার্থীদের অনবরত ব্যবহারের ফলে টালিগুলির উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেছে।

পাথরের সমাধিসৌধে ব্যবহূত একটি লিপি থেকে জানা যায় যে, ২৭ জিলহজ ৮৬৩ হিজরিতে (২৫ অক্টোবর ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) খান জাহান আলী মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি এ সমাধি নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের নিয়মিত সংস্কার কাজের ফলে ভবনটি আজও সুরক্ষিত রয়েছে। এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো বর্গাকার পরিকল্পনা, খিলান এবং সরদলে ফিরুজশাহী স্থাপত্যের সমন্বয়, বক্র কার্নিশ, ঘোরানো ব্যান্ড দ্বারা বিভক্ত কর্ণার টাওয়ার এবং গম্বুজের ভারবহনের জন্য নির্মিত স্কুইঞ্চ ইত্যাদি। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই একে হজরত পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধের মতো মনে হয়। তবে একলাখী ভবনটি ছিল অভ্যন্তরে অষ্টভুজী আর খান জাহানের সমাধিসৌধটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকেই চতুর্ভুজ আকৃতির। একক গম্বুজ সমৃদ্ধ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের নির্মাণ ধারার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে অষ্টভুজী কর্ণার টাওয়ার পরিলক্ষিত হলেও খান জাহানের সমাধিসৌধ ও তাঁর অন্যান্য স্থাপত্যগুলিতে গোলাকার কর্ণার টাওয়ার দেখা যায়। তাঁর সমাধিসৌধে গোলাকৃতির কর্ণার টাওয়ার, দেয়ালের খালি গাত্রদেশ এবং খিলান ও সরদলের অপূর্ব সমন্বয় দিল্লির তুগলক স্থাপত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ তুগলকীয় উপাদানের ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো পন্ডিত খান জাহানের স্থাপত্য দিল্লির স্থাপত্য থেকে উদ্ভূত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে ফিরুজ শাহ তুগলক এর বাংলা অভিযানের সময় আগত এবং ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর কর্তৃক দিল্লি ধ্বংসের কারণে এ অঞ্চলে এসে অভিবাসন স্থাপনকারী কারিগররাই বাংলার স্থাপত্যে তুগলকীয় উপাদানের সূচনা ঘটায়।

মুহম্মদ তাহিরের সমাধি খান জাহানের সমাধি সৌধের সামান্য পশ্চিমে অবস্থিত। এটি তিন স্তরবিশিষ্ট একটি পাথরের স্মৃতিস্তম্ভের মতো। উপরের স্তরে খোদিত একটি লিপি থেকে জানা যায় যে, মুহম্মদ তাহের ৮৬৩ হিজরির জিলহজ মাসে (১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। স্থানীয় জনশ্রুতি নির্দেশ করে যে, তাহির ছিলেন খান জাহান আলীর প্রিয় একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। খান জাহানের সমাধির পাশে তাঁর সমাধিসৌধের অবস্থান এ বিশ্বাসকেই জোরদার করে।

মসজিদ  এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি কমপ্লেক্স-এর সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত। এটি বর্গাকার পরিকল্পনায় ইট দ্বারা নির্মিত একটি মসজিদ। এর উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব পাশে তিনটি খিলানপথ রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের খিলান দরজাগুলি এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরের দিকে কিবলা দেয়ালের সাথে রয়েছে একটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। এর অবস্থান ঠিক পূর্বদিকে খিলানপথ বরাবর। মসজিদটির বাইরের চারপাশে রয়েছে চারটি গোলাকার কর্নার টাওয়ার এবং বক্র কার্নিশ। গোলার্ধ আকৃতির ইটের গম্বুজ বর্গাকার কক্ষটিকে আবৃত করেছে। এটি পাথরের নির্মিত ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চকে স্পর্শ করেছে। নির্মাণ পরিকল্পনা ও গঠনশৈলীর দিক থেকে এটি খান জাহানের সমাধির অনুরূপ। এদিক থেকে বলা যায় যে, সম্ভবত খান জাহানের সমাধিসৌধ নির্মাণকালে অর্থাৎ পনেরো শতকের মাঝামাঝিতে এ মসজিদটিও নির্মিত হয়।

তথাকথিত রান্নাঘর খানজাহানের সমাধিসৌধ থেকে কয়েক মিটার পূর্বদিকে একটি ভবন ছিল। বর্তমানে এটি মাটির সাথে মিশে গেছে। বিশ শতকের সত্তরের দশকেও এটি সংরক্ষিত ছিল। তবে তখনও এর চার দেয়াল অক্ষত থাকলেও চৌচালা ছাদটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর পশ্চিম, উত্তর এবং দক্ষিণ পাশে ছিল তিনটি খিলানযুক্ত দরজা। এর ভেতরের দিকের পূর্ব দেয়ালে ছিল বেশ কিছু তাক।

আয়তাকার রান্নাঘরটি ছিল ১২.২ মিটার দীর্ঘ এবং ৫.৮ মিটার চওড়া। এ ভবন মূলত কি উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল তা জানা যায় নি। স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, খান জাহান তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলি যেখানে তিনি এখন সমাহিত সেখানে বাস করতেন এবং পার্শ্ববর্তী ভবনটিকে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আনুমানিক এক শতক পূর্বে মসজিদ এবং সমাধিসৌধ তত্ত্বাবধানকারী দুজন ফকির ভবনটিকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।  [এম.এ বারি]