খান, মির্জা আবু তালেব

খান, মির্জা আবু তালেব (১৭৫২-১৮০৬)  প্রথম দিকের যে সকল ভারতীয় পর্যটক পাশ্চাত্যদেশ সম্পর্কে ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনা করেছেন তাদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত মির্জা আবু তালেব খান। আবু তালেব সম্পর্কে সবিস্তারিত জানা যায় চালর্স স্টুয়ার্টের ট্রাভেলস অব আবু তালেব খান (১৮১৪) গ্রন্থ থেকে। এটি মির্জার ফারসি গ্রন্থ মাসায়ের তালেবি ফি বালাদ আফরেঞ্জি (ইউরোপে তালেবের ভ্রমণবৃত্তান্ত) গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ। ইলিয়ট ও ডাউসনের দি হিস্টরি অব ইন্ডিয়া এজ টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ানস (অষ্টম খন্ড) গ্রন্থে মির্জার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে মির্জার পুরো নাম আছে মির্জা আবু মুহম্মদ তাবরিজি ইস্পাহানি। এখানে বলা হয়েছে যে, তিনি হাজার হাজার ঐতিহাসিক অভিসন্দর্ভ পাঠ করেছেন এবং ফারসি ভাষায় এর সারসংক্ষেপ লুববুস সিয়ার ওয়া জাহান-নুমা (জীবনকাহিনীর সারসংক্ষেপ এবং বিশ্ব-প্রতিফলনকারী দর্পণ) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি আরও কিছু সন্দর্ভ, প্রাচীন ও আধুনিক কবিদের একটি জীবনীগ্রন্থ এবং বেশসংখ্যক কবিতা রচনা করেছেন।

আবু তালেবের জন্ম ১৭৫২ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে। তাঁর পিতা হাজী মুহম্মদ বেগ খান ছিলেন ইস্পাহানে জন্মগ্রহণকারী একজন তুর্কি। তিনি পারস্যের নাদির শাহের অত্যাচারে পালিয়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে অযোধ্যার নওয়াব আবুল মনসুর খান সফদর জঙ্গের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সফদর জঙ্গের মৃত্যুর পর তিনি বাংলায় পালিয়ে আসেন এবং ১৭৬৮ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এখানে মর্যাদার সাথে বসবাস করেন। আবু তালেব তাঁর মায়ের সঙ্গে লক্ষ্ণৌতেই থেকে যান এবং নওয়াবের খরচে লেখাপড়া করতে থাকেন। ১৭৬৬ সালে মাতা ও পুত্র মুর্শিদাবাদে এসে মুহম্মদ বেগ খানের সঙ্গে মিলিত হন। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব অর্পিত হয় আবু তালেবের ওপর। তিনি নওয়াব মুজাফফর জঙ্গের অধীনে কয়েক বছর চাকরি করেন।

আসফউদ্দৌলার অযোধ্যার সিংহাসনে আরোহণের পর আবু তালেব সেখানে ‘আমিলদার’ পদে নিযুক্ত হন। আমিলদারের প্রশাসনিক, সামরিক ও রাজস্ব এ তিন ধরনের দায়িত্বই ছিল। নওয়াবের প্রধানমন্ত্রী মুখতিয়ার উদ্দৌলা ছিলেন তাঁর পৃষ্ঠপোষক। দুবছর পর তাঁর মৃত্যু হলে তালেব চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং গোরখপুরের কালেক্টর কর্নেল আলেকজান্ডার হানের সহকারী হিসেবে তিন বছর চাকরি করেন। এরপর পুনরায় তিনি অযোধ্যার নওয়াবের চাকরি গ্রহণ করেন। বুলবদ্দর সিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহী জমিদারদের দমনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর শত্রুপক্ষ উজির হায়দার বেগ খানের নেতৃত্বে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলে তাঁর ভাগ্য অপ্রসন্ন হয়। ১৭৮৭ সালে তিনি লর্ড কর্নওয়ালিসের নিকট তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য কলকাতা আসেন। তখন লর্ড কর্নওয়ালিস দাক্ষিণাত্যে যাচ্ছিলেন টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য। ফলে পরবর্তী চার বছরের মধ্যে তিনি আবু তালেবের জন্য কিছু করতে পারেন নি। তিনি লক্ষ্ণৌর রেসিডেন্ট মি. চেরি ও নওয়াব আসফউদ্দৌলার নিকট আবু তালেবের পক্ষে জোর সুপারিশ করেন। তাঁরা উভয়েই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যান এবং রেসিডেন্ট ও নওয়াব উভয়ই তাঁকে পরিত্যাগ করেন। ফলে আবু তালেব কোন নিয়োগ প্রাপ্তির সুযোগ হতে বঞ্চিত হন। তিনি পুনরায় ১৭৯৫ সালে কলকাতা যান এবং একটি চাকরির জন্য তিন বছর অযথাই অপেক্ষা করেন। এসময়ই তাঁর জীবনে চরম দুর্যোগ নেমে আসে। তিনি লিখেছেন, ‘এই তিন বছর কলকাতায় চাকরির জন্য আমার অপেক্ষমাণ দিনগুলিতে আমার দুরবস্থা দেখে যারা আমার সহচর ছিল, যারা ছিল আমার উপর নির্ভরশীল তারা সকলেই আমাকে পরিত্যাগ করল; এমন কি আমার কয়েক সন্তান এবং যে সকল কর্মচারী আমার পিতৃগৃহে মানুষ হয়েছে তারাও আমাকে পরিত্যাগ করেছিল।’

এসময়ে ক্যাপ্টেন ডেভিড রিচার্ডসন নামে তাঁর এক স্কটিশ বন্ধুর নিকট হতে একটি প্রস্তাব আসে। রিচার্ডসন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি আবু তালেবকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর সফরসঙ্গী হতে। রিচার্ডসন অঙ্গিকারবদ্ধ হন যে, তিনি আবু তালেবের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন এবং সমুদ্র যাত্রাকালে তাঁকে ইংরেজি ভাষা শেখাবার চেষ্টা করবেন।

আবু তালেব তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং দুই বন্ধু ১৭৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ডেনমার্কের এক জাহাজে উঠে বৃটেনের পথে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে আগুন লাগার কারণে একটি পরিত্যক্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ দেখতে পান। ডেনমার্কের জাহাজের ক্যাপ্টেন ও তার লোকেরা সেই জাহাজের মালামাল লুঠ করে আবার যাত্রা করে। কিন্তু উত্তমাশা অন্তরীপে এসে তারা ধরা পড়ে। তখন আবু তালেব ও রিচার্ডসন লন্ডনগামী দক্ষিণ সাগরের তিমি শিকারী এক জাহাজে ওঠে পড়েন। সেসময় ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তাই তাঁরা সর্বক্ষণ এমনই আশংকায় ছিলেন যে, কোন জাহাজ আসতে দেখলেই তাঁরা শনাক্ত করতেন সামনের জাহাজ শত্রুপক্ষের না মিত্রপক্ষের।

তাঁরা প্রথম যে ইউরোপীয় বন্দরে এসে পৌঁছেন সেটি আয়ারল্যান্ডের কর্ক বন্দর। রিচার্ডসন ও আবু তালেব বন্দরে অবতরণ করলে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। সেখানে এক বাড়িতে আবু তালেব তখন শেখ দীন মহম্মদ নামে এক ভারতীয়ের সাক্ষাৎ পান। দীন মুহম্মদ তখন কর্ক শহরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। দীন মেহম্মদ সেখানে বিয়ে করেছেন এবং ইংরেজি ভাষায় একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন।

কলকাতা ফেরতা লর্ড কর্নওয়ালিস তখন আয়ারল্যান্ডে রাজার প্রতিনিধি। এ সংবাদ পেয়ে আবু তালেব ডাবলিনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে মনস্থির করলেন। স্থলপথে ডাবলিনে যাবার সময় একদিকে যেমন তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে চমৎকৃত হন, অন্যদিকে তেমনি বিস্মিত হন গ্রামাঞ্চলে সাধারণ কৃষকের দারিদ্র্য দেখে। তুলনামূলকভাবে ভারতীয় কৃষকদের চেয়ে এদের অবস্থা ছিল অনেক বেশি খারাপ। তিনি ডাবলিন শহর ও এর অধিবাসীদের প্রতি এমনই আকৃষ্ট হলেন যে সেখানে আরও কিছুকাল অবস্থানের মনস্থ করলেন। তখন রিচার্ডসন তাঁকে রেখেই লন্ডন চলে যান। আবু তালেব তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে একটি আলাদা অধ্যায়ে আইরিশ চরিত্রের সূক্ষ্ম চিত্রায়ন করেছেন।

অবশেষে আবু তালেব ১৮০০ সালের ২১ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছেন। আড়াই বছরকাল সেখানে তিনি অনেকটা ভোগ-বিলাসেই সময় অতিবাহিত করেছেন। লন্ডনে তিনি ছিলেন অনেকটাই আয়েশি ফুর্তিবাজ। সেখানকার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলি তাঁকে এমনই আপ্যায়ন করত যেন তিনি এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব। তাঁর ইংল্যান্ডের জীবন সম্পর্কে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘সম্ভবত কেউ কেউ আমাকে আত্মম্ভরিতার জন্য দোষারোপ করবেন, যদি বলি আমার জন্য সবাই ছিল পাগল; আমার বাকচাতুরি, যখন তখন প্রাচ্যদেশীয় কবিতার চরণ উদ্ধৃতি দেওয়ার ক্ষমতা ভদ্র সমাজের আলোচ্য বিষয় ছিল। নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করি, বিলেতে থাকাকালে সেখানকার শীতল আবহাওয়া এবং সকল প্রকার দুশ্চিন্তা বিবর্জিত জীবন যেন আমাকে অমর কবি হাফিজের উপদেশ পালনে উদ্বুদ্ধ করেছিল; তাই আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম প্রেম ও আনন্দে।’ একবার তিনি ভক্সহল উদ্যানে আনন্দ উৎসবের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলে সংবাদপত্রে খবর বেরুল, ‘প্রিন্স আবু তালেব নির্ধারিত রাতে উপস্থিত থেকে উদ্যানকে সম্মানিত করবেন’। যখনই তিনি রাজ দরবারে যেতেন (রাজা তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতেন) অথবা কোন রাজকন্যার সঙ্গে বা রাষ্ট্রের কোন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা দেখা করিয়ে দিতেন। সংবাদপত্রে ওসব খবর ছাপা হতো এবং তাঁকে অভিহিত করা হতো ‘পারস্যের শাহজাদা’ বলে। আবু তালেব অবশ্য বলেন যে, তিনি কখনই এ পদবি গ্রহণ করেন নি। ‘কিন্তু তবুও আমি আমার নিজস্ব নাম অপেক্ষা সেই পদবিতেই অধিক পরিচিত ছিলাম। দেখেছি, এ নিয়ে আমার এই উপাধি দাতা গডফাদারদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা; তাঁরা কোন যুক্তিই মানতে রাজি নন’।

বিলেতের অভিজাত পরিবারের লোকদের ছাড়াও আবু তালেব সেখানকার কারুকলা, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রের অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছয়টি পোট্রেটের জন্য শিল্পীর সামনে আসন পেতেছিলেন। এ ছবির একটি এঁকেছিলেন রয়্যাল অ্যাকাডেমিশিয়ান নর্থকোট। তিনি ইতিপূর্বে মির্জা শেখ ইহতেশামউদ্দীন-এর চিত্রও অঙ্কন করেছিলেন। অভিজাতদের মধ্যে স্বনামখ্যাত ডেবার, নিলামকারি ক্রিষ্টি এবং চীনামাটির তৈজসের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ওয়েজউড-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে।

আবু তালেবের বিলেত ভ্রমণের বিবরণ স্পষ্টত তাঁর স্বদেশবাসীকে বিলেতের বিচিত্র বিষয়ের উপর ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত। সেদেশের চিত্রকলা ও বিজ্ঞান, যান্ত্রিক আবিষ্কার, বিভিন্ন লোকের জীবনযাপন পদ্ধতি, সরকার পদ্ধতি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বিচারব্যবস্থাপনা এবং ইংরেজদের চরিত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুণাবলি ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। একটি অধ্যায়ে ইউরোপ, বিশেষ করে ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ডের সংঘাত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অপর অধ্যায়ে রয়েছে ইংরেজদের বহির্বিশ্ব বিজয়ের বর্ণনা। সেখানে ইংলন্ডের সঙ্গে ফ্রান্সের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে।

আবু তালেবের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের তুলনামূলক আলোচনা সাংস্কৃতিক বিষয়ের ছাত্রদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয় হতে পারে, কারণ সেখানে সুবিন্যস্ত ও অকাট্য যুক্তি প্রকাশে সক্ষম মন-মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। এর একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যায়। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বাহ্যত যা-ই মনে হোক না কেন ভারতীয় মহিলারা ইংরেজ মহিলাদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। এ বিষয়ে তিনি একটি পৃথক নিবন্ধ রচনা করেছেন এবং সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ক্যাপটেন ডেভিড রিচার্ডসন। নিবন্ধটি ১৮০১ সালে এশিয়াটিক অ্যানুয়াল রেজিস্ট্রারে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা পরবর্তীকালে ট্রাভেলস অব আবু তালেব খান গ্রন্থের ভারতীয় সংস্করণে সংযুক্ত হয়েছে।

পাঠক আবু তালেবের হালকা মেজাজের রচনার অংশগুলিও উপভোগ করবেন। যেমন তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি স্বভাবগতভাবেই প্রণয়ী এবং খোলামেলাভাবে মহিলাদের সঙ্গে তিনি তাঁর প্রণয়কৌতুকের বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর নিজের অথবা অপরের কবিতার উদ্বৃতি অনেকে উপভোগ করবেন। লন্ডনে পৌঁছেই আবু তালেব নগরকে উদ্দেশ্য করে একটি গাঁথা রচনা করেন। এই গাঁথার পুরোটাই মুদ্রিত হয়েছে। এতে রয়েছে বিলেতের প্রতি তাঁর প্রবল মোহ-মুগ্ধতা ও নতুন ধর্মবিশ্বাসের প্রতি মানসিক প্রবণতার সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশ। আবু তালিব বর্ণনার এক পর্যায়ে বলেন যে, এসব বিষয়ে একটি কথায় আপত্তি উঠতে পারে, আমার বিলেত ও বিলেতি সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসায় যদি মক্কার শেখ অসন্তুষ্ট হন তাতে কি আসে যায়’? তাঁর দেহমন তখন ‘বিলেতী রূপসীদের’ প্রতি নিবেদিত।

যে পথে আবু তালেব বিলেতে এসেছিলেন সে পথে প্রত্যাবর্তন না করে তিনি স্থলপথে ফ্রান্স, ইটালি, তুরস্ক ও বর্তমান ইরাকের মধ্য দিয়ে দেশে ফেরার মনস্থির করেন। ১৮০২ সালের ৭ জুন তিনি লন্ডন থেকে স্বদেশ রওয়ানা হন। তাঁর সঙ্গে ছিল ইংরেজ সরকারের মন্ত্রী মি. পেলহামের দেওয়া একটি পরিচয়পত্র। পরের বছর ৪ আগস্ট তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছেন। ফিরতি পথের ভ্রমণবৃত্তান্ত জুড়ে আছে তাঁর ট্রাভেলস গ্রন্থের এক তৃতীয়াংশ। ইংল্যান্ড সম্পর্কে বর্ণনায় তিনি যেরূপ তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন, প্রত্যাবর্তনকালীন ভ্রমণবৃত্তান্তেও অনুরূপ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন। ফ্রান্স সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে ‘ফরাসিরা কখনও ইংরেজদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারবে না।’

ফ্রান্সে তাঁর অভ্যর্থনা হয়েছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। সেখানে তিনি দুজন প্রসিদ্ধ পাচ্য বিদ্যাবিশারদ মশিয়েঁ ল্যাংলি ও মশিয়েঁ দ্য স্যাসির সাক্ষাৎ লাভ করেন। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মশিয়েঁ ট্যালিরান্দ ও স্বয়ং নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁকে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আকস্মিক অসুস্থতার কারণে তা গ্রহন করা আর হয়ে ওঠেনি। তুরস্কের সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি তাঁকে একটি দুর্লভ আরবি অভিধান উপহার দেন। লক্ষণীয় যে, তিনি তুর্কিদের বেশ কিছু ত্রুটির উল্লেখ্য করেন; আরব প্রজাদের উপর তুর্কিদের অত্যাচার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এবং একই সঙ্গে ওহাবী আন্দোলনএর চরমপন্থী মতবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন।

ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনের পর আবু তালেব বুন্দেলখন্ডের এক জেলায় আমিল বা জেলা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৮০৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের জন্য অবসর ভাতার ব্যবস্থা করে। তাঁর পুত্র মির্জা হোসেন আলীর তত্ত্বাবধানে ট্রাভেলস-এর ফারসি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। বর্তমানে সাংস্কৃতিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যর প্রতি গবেষকদের ক্রমবর্ধমান মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ার ফলে এই গ্রন্থটিও এ জাতীয় অপরাপর ক্লাসিক্যাল গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করার মত।  [কায়সার হক]