খান, ফজলুর রহমান১

ফজলুর রহমান খান

খান, ফজলুর রহমান১ (১৯২৯-১৯৮২)  স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্কাইস্ক্র্যাপার্স নির্মাণ কৌশলে বিপ্ললব সাধন করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভান্ডারীকান্দি গ্রাম। ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা শহরে জন্ম। তাঁর পিতা খান বাহাদুর আবদুর রহমান খান ছিলেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ১৯৪৪ সালে কলকাতার বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ-এ ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট) শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে ফুলব্রাইট ফেলোশিপ ও ফোর্ড ফাইন্ডেশন স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমুর-এ যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।

ফজলুর রহমান খান শিকাগোর একশ তলা উঁচু জন হ্যানকক সেন্টার এবং একশ দশ তলা উঁচু সিয়ার্স টাওয়ার-এর নকশা তৈরি করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডস কর্তৃক ‘কন্সট্রাকশনস ম্যান অব দি ইয়ার’ মনোনীত হওয়ার পর ১৯৭১ সালে শিকাগোর ওন্টারিও সেন্টারে  একটি ফলকে তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য লেখা হয় ‘ইনোভেশন ফলোজ প্রোগ্রাম’।

স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এফ. আর খানের খন্ডিত প্রাচীর ফ্রেম পদ্ধতি (shear wall frame interaction system), ফ্রেমড্-টিউব স্ট্রাকচার (framed tube structure) এবং টিউব-ইন-টিউব স্ট্রাকচার (tube in tube structure) স্ট্রাকচারাল পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি বিধান করেন। উচ্চ ভবন নির্মাণ হয়ে ওঠে অর্থনৈতিকভাবে সহজসাধ্য। ফ্রেমড্ টিউব পদ্ধতিতে কলামগুলি বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপিত না হয়ে বরং ভবন চৌহদ্দির কাছাকাছি স্থাপিত হয় এবং স্প্যান্ড্রেল বীম প্রতি তলায় কলামগুলিকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে। এই পদ্ধতি সর্বপ্রথম ব্যবহূত হয় ১৯৬৪ সালে শিকাগোর ডিউইট চেষ্টনাট ভবনে। তেতাল্লিশ তলা উঁচু রিইনফোর্সড কংক্রিট টাওয়ারটির নকশা করেছিলেন স্কিডমুর ওইংস ও মেরিল (SOM)-এ কর্মরত এফ. আর খান ও তাঁর সহকর্মীগণ। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ও দৃঢ় টিউবুলার পদ্ধতিটি (tubular form) হাই রাইজ ভবন নির্মাণে একটি স্ট্যান্ডার্ড মান হয়ে দাঁড়ায়।

ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এফ. আর খান প্রতিটি স্থাপত্য ক্রমের জন্য প্রযোজ্য স্ট্রাকচারাল সিস্টেম উদ্ভাবন করেন। শিকাগোর SOM-এর প্রধান স্থপতি ব্রুস জে গ্রাহামের সহযোগিতায় এফ. আর খান শিকাগোর একশ তলা জন হ্যানকক ভবনের জন্য ট্রাসড্ টিউব স্ট্রাকচারাল সিস্টেম (trussed tube structural system) পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।

পরে তিনি বান্ডলড্ টিউব (bundled tube) নামক আর একটি স্ট্রাকচারাল সিস্টেম প্রয়োগ করেন। এই পদ্ধতি শিকাগোর ১১০ তলা উঁচু সিয়ার্স টাওয়ারের জন্য ছিল অত্যন্ত কার্যকর। ১৪৫৪ ফুট উঁচু ভবনটি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং অপেক্ষা উচু এবং বেশি স্থান জুড়ে নির্মিত হওয়া সত্ত্বেও প্রতি ইউনিটে এর খরচ হয়েছে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর চেয়ে কম। এই নতুন পদ্ধতি স্থাপত্যিক স্থান সংকুলানে অত্যন্ত কার্যকর। এখন উঁচু টাওয়ার বাক্সের আকারের মতো করে তৈরি হয় না, কেন না টিউব স্ট্রাকচারে ভবন যে কোনো আকৃতি নিতে পারে। এফ. আর খান কর্তৃক উদ্ভাবিত ফ্রেমড্ টিউব স্ট্রাকচার, ওয়াল ফ্রেম ইন্টারএ্যাকশন, ট্রাস্ড টিউব, বান্ডলড্ টিউব এবং কম্পোজিট সিস্টেম আজকের প্রচলিত স্কাইস্ক্র্যাপার্সে ব্যবহূত হচ্ছে।

১৯৭৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার জনগণ নতুন নতুন বাড়ি, অফিস ও অন্যান্য সুবিধাদি নির্মাণে আগ্রহী হলে এসওএম এই কাজগুলি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পায় এবং এফ. আর খান চাহিদা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলি সমাধা করতে সক্ষম হন। সৌদি আরবের জেদ্দা বিমান বন্দরে আরবের ঐতিহ্যবাহী বেদুইনদের তাঁবু আর আধুনিক কারিগরি দক্ষতার মিশ্রণে নির্মিত হজ টার্মিনালটি (৮০,০০০ হজ যাত্রী যেখানে একত্রে একনাগাড়ে ৩৬ ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে সক্ষম) ফজলুর রহমান খানের আরেক বিশাল স্থাপত্যিক কীর্তি।

ফজলুর রহমান খান ১৯৭২ সালে আরবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যালুমনি এওয়ার্ড, ১৯৭৩ সালে নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট অব সায়েন্স এবং ১৯৮০ সালে লেহাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অব ইঞ্জিনিয়ারিং সম্মানে ভূষিত হন।

১৯৬১ সালে ফজলুর রহমান খান স্কিডমুর ওইংস অ্যান্ড মেরিলের পার্টিসিপেটিং অ্যাসোসিয়েট নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি এর সহযোগী অংশীদার এবং ১৯৭০ সালে জেনারেল অংশীদার হন। সে সময়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র ইঞ্জিনিয়ার পার্টনার।

১৯৭৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ একজন ইঞ্জিনিয়ারের জন্য প্রদেয় সর্বোচ্চ সন্মানে ভূষিত হন। ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডস-এর ‘ম্যান হু সার্ভড দি বেষ্ট ইন্টারেস্ট অব দি কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি’-তে ফজলুর রহমানের নাম পাঁচ বার এসেছে (১৯৬৫, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১ এবং ১৯৭৯ সালে)। ১৯৭২ সালে তিনি ‘কন্সট্রাকশনস ম্যান অব দি ইয়ার’-এ ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালে আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস ফজলুর রহমান খানকে তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য এআইএ ইন্সটিটিউট সম্মাননা প্রদান করে। একই বছর মুসলিম স্থাপত্যে অসাধারণ অবদানের (জেদ্দার হাজী টার্মিনাল) জন্য তাঁকে ‘আগা খান’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।

ইলিনয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ১৯৮৭ সালে ফজলুর রহমান খানকে মরণোত্তর ‘জন পারমার’ সম্মানে ভূষিত করে এবং সিয়ার্স টাওয়ারের লবিতে স্পেনীয় ভাস্কর কার্লোস ম্যারিনাস নির্মিত এফ. আর খানের ভাস্কর্য স্থাপন করে।

ফজলুর রহমান খান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ তিনি হূদরোগে মারা যান। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করে এবং তাঁর স্মরণে স্মারক একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।  [রাশিমুল হক]