খান, সুলেমান
খান, সুলেমান (১৯৩৯-১৯৭১) চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। সুলেমান খান ১৯৩৯ সালে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় শেখদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোঃ ইউসুফ খান ছিলেন সেনিটারি ইন্সপেক্টর এবং মাতা নূরেন্নেসা খানম। সুলেমান খান চাঁদপুর হাসান আলী হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে প্রবেশিকা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে আইএসসি পাস করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করে সুলেমান খান ১৯৬৯ সালে টঙ্গী জুট মিলে আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ঢাকার গোপীবাগে রাশেদ মেডিক্যাল ফার্মেসিতে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বার।
ছাত্রজীবনেই সুলেমান খান রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগী সদস্য এবং পরে দলের নিয়মিত সদস্য হন। সুলেমান খান ও তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। শিল্পীদের গণসঙ্গীতে প্রশিক্ষণ দানের জন্য উদীচির গৃহীত কর্মসূচি শুরুতে সুলেমান খানই পরিচালনা করতেন। তাঁর গোপীবাগের বাসায়ই তখন গণসঙ্গীত শিক্ষার ক্লাশ অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকায় ‘তরঙ্গ’ নামে একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এ সংগঠনের সভাপতি। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে তরঙ্গের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সুলেমান খান পৃথিবী নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। শহীদ দিবস উপলক্ষে ‘তরঙ্গ’ কর্তৃক প্রকাশিত দুটি সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন সুলেমান খান। বিবর্তনবাদ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর রচিত কিছু সংখ্যক নিবন্ধ পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সুলেমান খান তাঁর পরিবার পরিজনসহ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। উদ্দেশ্য ছিল, সেখান থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। গ্রামের বাড়িতে অবস্থানকালে তিনি স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। এ ছাড়া চাঁদপুরে পাকসেনাদের গুলিতে আহত অবস্থায় যাদের মফস্বল এলাকায় নিয়ে আসা হচ্ছিল তাদের চিকিৎসায় তিনি আত্মনিয়োগ করেন। অচিরেই স্থানীয় মুসলিম লীগ কর্মিদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাঁধে। সে সময় আওয়ামী লীগ কর্মিরা একটি নৌকায় করে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য পাঠায়। ওই গ্রামের কাছেই নৌকার যাবতীয় অস্ত্র ও রসদ লুট হয়ে যায়। গ্রামে সালিশ বৈঠকে মুসলিম লীগ কর্মিরা অস্ত্র ও রসদ ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করে। পরে সুলেমান খান লুণ্ঠিত দ্রব্য ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে তারা তাঁর উপর ক্ষেপে যায়।
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল রাতে প্রতিক্রিয়াশীলদের একটি সশস্ত্র দল সুলেমান খানের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সুলেমান খানের বুকে গুলি করে। সংঘর্ষে তাঁর মা ও ছোট ভাই হাশেম খান আহত হন। সুলেমান খানকে সঙ্গে সঙ্গে চাঁদপুর শহরে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। কিন্তু পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি শেখদিতে পারিবারিক গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ জাতির জন্য তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সুলেমান খানের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]