খান, মোহাম্মদ রফি
খান, মোহাম্মদ রফি (১৯২৮-২০১৬) এম.আর খান নামেই অধিক পরিচিত। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতিমান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী ছিলেন। ১৯২৮ সালের ১লা আগস্ট সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম জায়রা খানম এবং তার পিতা আব্দুল বারী খান, যিনি সমাজসেবার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
এম.আর খান কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘মহসিন স্কলার’ ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে, ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান এবং এডিনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিন থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ডিটিএমএইচ সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি এডিনবার্গ রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি এফসিপিএস (কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনদের ফেলো) ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি (রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানের ফেলো) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬২ সালে তিনি এমআরসিপি ডিগ্রি শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। তিনি ১৯৬৩-১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৬৪-১৯৬৯ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ১৯৭০-১৯৭৩ সালে পেডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে, স্নাতকোত্তর মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IPGMR) এর অধ্যাপক এবং যুগ্ম পরিচালক নির্বাচিত হন। এছাড়াও, ১৯৭৮-৭৯ সালে তিনি ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক এবং পরিচালক এবং ১৯৭৯-১৯৮০ সালে আইপিজিএমআর-এর শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ডা. এম.আর খান ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে আইপিজিএমআর (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) থেকে পেডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পেডিয়াট্রিক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৮-১৯৭৯ সালে ঢাকা শিশু হাসপাতালকে আরও শক্তিশালী করেন। ডা. এম.আর খান বাংলাদেশ শিশু বিশেষজ্ঞ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (idddr,b)-এর একজন সিনিয়র ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। এছাড়াও, তিনি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড শিশু হাসপাতালের একজন অধ্যাপক, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ডা. এম.আর খান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পোলিও নির্মূল সার্টিফিকেশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে পোলিও, ডিপথেরিয়া, পেরটুসিস এবং টিটেনাসের বিরুদ্ধে হোচেস্টের তৈরি কম্বাইন্ড ভ্যাকসিন ‘কুর্ট্রোভিরিলন’ প্রবর্তন করেন। এছাড়া ‘আধুনিক’ (তামাকবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা)-এর সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন।
শিশুস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে যুক্তরাজ্যের কেম্ব্রিজের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ‘WHO’s WHO’ অব ইন্টেলেকচুয়ালস (৭ম সংস্করণ)’-এ অধ্যাপক এম আর খানের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হন, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে ১৯৯১ সালে ম্যানিলায় আয়োজিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ পেডিয়াট্রিক্স কর্তৃক প্রদত্ত স্বর্ণপদক’, ১৯৯৩ সালের ‘কবি নজরুল ইসলাম জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণপদক’, ১৯৯৭ সালে কবি ‘সরোজিনী নাইডু স্বর্ণপদক’ ১৯৯৮ সালে ‘খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ স্বর্ণপদক’ ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ‘জাতীয় সমাজসেবা স্বর্ণপদক’; ২০০৬ সালে ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ ফিজিশিয়ান বাংলাদেশ স্বর্ণপদক’। ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর একজন বিশিষ্ট ফেলো ছিলেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস তাঁকে বিএএস- প্রফেসর ইমেরিটাস ড. সুলতান আহমেদ চৌধুরী জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্বর্ণপদক পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এছাড়াও, ২০০৯ সালে তিনি সমাজসেবায় ‘একুশে পদক’ এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন।
ডা. এম.আর খান বেশ কয়েকটি সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলোর মধ্যে শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (১৯৮৩); শিশু হাসপাতাল, মিরপুর, ঢাকা (১৯৯৫); শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মিরপুর, ঢাকা (২০০৬); ইনস্টিটিউট অব নার্সিং, মিরপুর, ঢাকা (২০০৮); শিশু হাসপাতাল, যশোর (২০০০); ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, সাতক্ষীরা (২০০০); সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তা কেন্দ্র, সাতক্ষীরা; সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল (১৯৮৮); মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হাসপাতাল, উত্তরা, ঢাকা (১৯৯২); নিবেদিতা নার্সিং হোম, ঢাকা এবং সেন্ট্রাল হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ডা. এম.আর খান ২০১৬ সালে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (CUST) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি দূরদর্শী ভূমিকা পালন করেন। অবসরগ্রহণের পর তাঁর সমস্ত পেনশন এবং গ্র্যাচুইটির অর্থ দিয়ে ‘ডা. এম.আর খান এবং আনোয়ারা ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ট্রাস্ট ফান্ড দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যথার্থ ব্যক্তিদের স্বর্ণপদক প্রদান করে আসছে।
ডা. এম.আর খান ৫ই নভেম্বর ২০১৬ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সাতক্ষীরায় পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। [ইয়ারুল কবীর]