খান, উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ
খান, উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ (১৯৪০-২০১১) বিমানবাহিনী অফিসার, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, রাজনীতিক। মুন্সিগঞ্জ জেলায় লৌহজং উপজেলার মেদিনীমন্ডল গ্রামে ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। পিতা মুহাম্মদ দবিরউদ্দিন খান ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং তাঁর মাতা জসিমুন্নেসা। হামিদুল্লাহ খানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় পিতার বিভিন্ন কর্মস্থলে। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন।
হামিদুল্লাহ খান ১৯৬০ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। দুই বছর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬২ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে তিনি পূর্বপাকিস্তান বিমানবাহিনীর সদর দফতরে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট মার্শাল পদে কর্মরত ছিলেন।
হামিদুল্লাহ খান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই যুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমদিকে তিনি বিহারের চাকুলিয়ায় সর্ববৃহৎ গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১০-১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্সে মুখ্য প্রতিনিধিদের একজন ছিলেন হামিদুল্লাহ খান। পরে তিনি ১১ নং সেক্টরে মাইনকারচর সাব-সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। যুদ্ধে তাঁর সফল নেতৃত্ব ও বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ফিল্ড প্রমোশন দিয়ে স্কোয়াড্রন লীডার পদে উন্নীত করেন। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর হামিদুল্লাহ খান ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। এই সেক্টরের আওতায় ছিল সম্পূর্ণ টাঙ্গাইল জেলা এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা ব্যতীত পুরো ময়মনসিংহ জেলা। বিমানবাহিনীর একজন অফিসার হয়েও তিনি তাঁর অধীনস্থ ২২,৮০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন। অধিকন্তু তিনি স্থানীয় গেরিলা যোদ্ধাদের সংগঠিত করে এই সেক্টরে ব্যাপক গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতার পর হামিদুল্লাহ খান বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে স্কোয়াড্রন লীডার পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের প্রথমদিকে তিনি উইং কমান্ডার হিসেবে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর শৌর্য ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার হামিদুল্লাহ খানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। তাঁর নামে ঢাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক শহর বনানীর ২৩ নং সড়কের নতুন নামকরণ হয় হামিদুল্লাহ খান সড়ক।
হামিদুল্লাহ খান ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মুন্সিগঞ্জ-২ আসন থেকে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১ সালে পুনরায় তিনি একই নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়ে তিনি বিএনপি ত্যাগ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তবে এক বছরের মধ্যেই তিনি বিএনপির রাজনীতিতে ফিরে যান। হামিদুল্লাহ খান ২০০৮ সালে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকার মিরপুর নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মেলন সংগঠনে তাঁর মুখ্য ভূমিকা ছিল।
হামিদুল্লাহ খান বেশসংখ্যক সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন জনতা ব্যাংকের পরিচালক মন্ডলীর চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান। তিনি তাঁর নিজ গ্রাম মেদিনীমন্ডলে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
একজন লেখক হিসেবে হামিদুল্লাহ খানের পরিচিতি ছিল। বিভিন্ন সাময়িকী ও পত্রপত্রিকায় তাঁর কিছুসংখ্যক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে একাত্তরে উত্তর রণাঙ্গন, বাঙালির স্বাধীনতার পটভূমি।
২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [মাহমুদ আলম চৌধুরী]