খাতুন, সাহারা
খাতুন, সাহারা (১৯৪৩-২০২০) রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনজীবী এবং রাজনৈতিক সংগঠক। ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায় বাবার বাড়িতে সাহারা খাতুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল আজিজ ও মায়ের নাম তুরজাননেছা। তিনি এডভোকেট সাহারা খাতুন নামেই সুপরিচিত ছিলেন।
১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। পরবর্তীতে, সিটি নাইট কলেজে শিক্ষা গ্রহণের পর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। অতঃপর সাহারা খাতুন জগন্নাথ কলেজে বি.এ কোর্সে ভর্তি হন। পরবর্তীতে, করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বি.এ (ডিগ্রি) অর্জন করেন। সাহারা খাতুন ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সেন্ট্রাল ল’ কলেজে অধ্যয়ন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় সাহারা খাতুন তাঁর কুর্মিটোলা স্কুল মাঠে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে বক্তৃতা দিয়ে স্কুলজীবনেই রাজনীতির সূচনা করেন। পরবর্তীতে, ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। রাজনৈতিক পথপরিক্রমার প্রথমভাগেই একজন সফল সংগঠক রূপে সাহারা খাতুন আবির্ভুত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সাহারা খাতুন ১৯৮১ সাল থেকে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করার জন্য ‘বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’ গঠন করেন। সাহারা খাতুন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিভিন্ন কার্যক্রমে তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবন চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি উপস্থিত ছিলেন।
সাহারা খাতুন ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে, সফল হতে পারেন নি। পরবর্তীতে, ২০০৮ সালের ২০শে ডিসেম্বর সাহারা খাতুন পুনরায় সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৮ আসন থেকে বিজয়ী হন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ সালের ৭ই জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ দিন পূর্বতন বাংলাদেশ রাইফেলস্ (বিডিআর)-এর সৈন্যরা ঢাকার পিলখানা সদর দফতরে সেনাবাহিনী থেকে নিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সাহারা খাতুন বিডিআর বিদ্রোহীদের নিরস্ত্র করার জন্য ২৫শে ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে, তিনি তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য প্রশংসিত হন। এছাড়াও, জনসাধারণকে উত্তম সেবা দানের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি থানায় ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করেন। তিনি সেবা প্রদান কর্মকর্তা নিয়োগসহ মডেল থানা, ভিকটিম সহায়তা কেন্দ্র, অভিযোগ সেল, হাইওয়ে পুলিশ এবং মহিলা সশস্ত্র পুলিশ প্রতিষ্ঠা করেন। তদুপরি, তাঁর নির্দেশনায়, মহিলা পুলিশ অফিসারদের প্রথমবারের মতো অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভায় রদবদলের কারণে ২০১২ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি পান এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত দুই বছর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। সাহারা খাতুন ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে পুনরায় নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক, মহিলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। সাহারা খাতুন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়াও, তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন, গাজীপুর বার অ্যাসোসিয়েশন এবং ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর কাজের জন্যও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। সাহারা খাতুন বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুগ্মসম্পাদক এবং সম্পাদক ছিলেন।
এছাড়াও, তিনি মানবাধিকার এবং নারীর উন্নয়নে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কাজ করেছেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল এলায়েন্স অফ ওমেন, এসোসিয়েটেড কান্ট্রি ওমেন অফ ওয়ার্ল্ড এবং ওমেন কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নরওয়ে, জাপান, ভারত, রাশিয়া, চীন, ইতালি, বুলগেরিয়া, হল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় আয়োজিত সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ডিপিআই এনজিও সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেন।
৯ই জুলাই ২০২০ সালে তিনি ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। [তাহমিদা খানম]
তথ্যসূত্র বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট, ১০জুলাই ২০২০; website of Ministry of Home Affairs, Government of the People's Republic of Bangladesh.