খনিয়াদিঘি মসজিদ
খনিয়াদিঘি মসজিদ বর্তমান নবাবগঞ্জ জেলার প্রাচীন গৌড় নগরের উঁচু মাটির দেওয়াল থেকে উত্তরে এবং বালিয়াদিঘি থেকে পশ্চিমে খনিয়াদিঘির পশ্চিম পাড়ে মসজিদটি অবস্থিত। এটি রাজবিবি মসজিদ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে মেরামতের পর মসজিদটি এখন সযত্নে সংরক্ষিত হচ্ছে।
প্রধানত ইটের তৈরি এ মসজিদে রয়েছে ৯ মিটার পার্শ্ববিশিষ্ট একটি বর্গাকৃতির প্রার্থনা কক্ষ এবং পূর্বদিকে ৯ মি. × ৩ মি. মাপের একটি বারান্দা। প্রার্থনা কক্ষের উপরের ছাদটি বিশাল গোলাকার গম্বুজ আকারে নির্মিত। অন্যদিকে বারান্দার উপরে আছে তিনটি ছোট গম্বুজ। প্রার্থনা কক্ষের বিশাল গম্বুজটি অন্তঃকোণগুলিতে নির্মিত অর্ধগম্বুজাকৃতির আড়াআড়ি খিলান (স্কুইঞ্চ), চার প্রধান পার্শ্বের বদ্ধ খিলান ও খিলানগুলির মধ্যবর্তী পেন্ডেন্টিভ এর উপর স্থাপিত। বারান্দার তিনটি ছোট গম্বুজ নির্মিত হয়েছে একই পদ্ধতিতে। বারান্দা থেকে প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের জন্য তিনটি খিলানপথ রয়েছে। এগুলি উচ্চতা ও প্রশস্তে পূর্ব দিকস্থ একক খিলানপথগুলির অনুরূপ ছিল। ইমারতের বাইরের চারকোণে রয়েছে চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ। এগুলি ছাদ পর্যন্ত উঁচু ছিল। আরও দুটি বুরুজ প্রার্থনা কক্ষ ও বারান্দা যেখানে মিলিত হয়েছে সে স্থানকে চিহ্নিত করেছে। বুরুজগুলিকে উত্থিত পট্টি দ্বারা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ইমারতের কার্নিশ সামান্য বক্রাকারে তৈরী।
কিবলা দেওয়াল অভ্যন্তরভাগে সম্পূর্ণরূপে গ্রানাইট পাথরের টুকরা দ্বারা আবৃত। এ দেওয়ালে আছে অর্ধবৃত্তাকৃতির কুলুঙ্গিতে তিনটি মিহরাব, পূর্ব দিকের তিনটি খিলানপথের বরাবরে। প্রার্থনা কক্ষের অন্য তিনটি দেওয়ালে খিলানের উত্থিতস্থলসমূহে সরদল আকারে পাথরের ব্লকগুলিকে স্থাপন করা হয়েছে। একই ধরনের পাথরের ব্লক দ্বারা তৈরী সরদল বারান্দার দেওয়াল পর্যন্ত সম্প্রসারিত ছিল। গম্বুজবহনকারী বদ্ধ খিলান ও স্কুইঞ্চগুলিকে দেওয়ালগুলিতে দৃঢ়ভাবে নিহিত পাথরের স্তম্ভগুলির উপর স্থাপন করা হয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের খিলান দুটিও, যা বারান্দার অভ্যন্তরভাগকে তিন অংশে বিভক্ত করেছে, সংযুক্ত পাথরের স্তম্ভের উপর স্থাপিত। তিনটি মিহরাবের মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্বস্থ দুটি মিহরাবের চেয়ে বড় এবং দেওয়ালের উচ্চতার পাশাপাশি বাইরের দিকে আয়তাকারে অভিক্ষিপ্ত। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এ মিহরাব কুলুঙ্গিগুলির প্রত্যেকটির মুখে খাঁজকাটা খিলান রয়েছে।
সম্পূর্ণ ইমারতটি এক সময় টেরাকোটা অলঙ্করণে শোভিত ছিল যার কিছু কিছু চিহ্ন ভেতরে ও বাইরে এখানে-সেখানে এখনও বিদ্যমান। ইমারতের চতুর্দিকে ছাঁচকৃত দুটি কার্নিশপট্টির মধ্যবর্তী স্থানসমূহে রয়েছে লতাপাতার নকশাসমৃদ্ধ ক্ষুদ্রাকৃতির খিলান সারি। এর আরও নিচে রয়েছে হীরকখন্ডাকৃতি ও বুটিদার নকশার সারিসহ একজোড়া সমতল পট্টিবলয়। চার দেওয়ালের সম্মুখভাগে (ফাসাদে) আছে স্পষ্টভাবে অভিক্ষিপ্ত আয়তাকারের প্যানেলের দুটি সারি। এগুলি জানালার ধারণা দেয়। এ ধরনের অলঙ্করণ কৌশল বাংলার সুলতানি আমলের মসজিদগুলি যেমন হজরত পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধ (পনেরো শতক), গৌড়ের তাঁতীপাড়া মসজিদ (১৪৮০) ও ছোট সোনা মসজিদ (১৪৯২-১৫১৯) এ অত্যন্ত লোকপ্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি প্যানেল আবার স্তম্ভের উপর খাজকৃত খিলান দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে যা ভেতরে ঝুলন্ত মোটিফ এবং স্প্যানড্রিলে গোলাপ নকশা প্রদর্শন করে।
কিবলা দেওয়ালের অভ্যন্তরভাগে মূল অলঙ্করণের বেশির ভাগ এখনও অক্ষতভাবে সংরক্ষিত আছে। খোদাই করা অলঙ্কৃত স্তম্ভগুলি, যার উপর মিহরাব খিলানগুলি স্থাপিত, চিরাচরিত ঝুলন্ত মোটিফ ও অন্যান্য নকশাসমূহ প্রদর্শন করে। মিহরাব খিলানগুলির স্প্যান্ড্রিল পূর্ণপ্রস্ফুটিত গোলাপ নকশায় অলঙ্কৃত। অন্যদিকে এগুলির আয়তাকার ফ্রেমগুলি অত্যন্ত চমৎকারভাবে দ্রাক্ষালতার প্যাঁচানো নকশা দ্বারা শোভিত। বদ্ধ খিলান এবং স্কুইঞ্চগুলির মধ্যবর্তী পেন্ডেন্টিভগুলি বড় স্তরকৃত গোলাপ নকশা দ্বারা চিহ্নিত। গম্বুজের বৃত্তাকার ভিত্তির ভেতরে ছাঁচকৃত কার্নিশপট্টি আছে, যার উপরের প্রান্ত (বর্ডার) কাঙ্গুরা মারলোন এবং উপরের অংশ বিচিত্র নকশা দ্বারা সজ্জিত।
মসজিদের নির্মাণ তারিখ কোনো শিলালিপি দ্বারা নির্ধারিত হয় নি। অবশ্য মধ্যবর্তী মিহরাবের উপরে একটি ‘এপিগ্রাফ’ আছে। এতে শুধু কুরআনের বাণী উৎকীর্ণ করা আছে। কিন্তু স্থাপত্যিক রীতি বিচারে মনে হয় যে, এটি পরবর্তী ইলিয়াসশাহী আমলে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়েছে।
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, এক গম্বুজ বিশিষ্ট প্রার্থনা কক্ষ এবং পূর্বদিকে তিন গম্বুজ সম্বলিত বারান্দাসহ মসজিদটি উৎকর্ষতার ক্ষেত্রে তৎকালীন বাংলায় প্রচলিত একগম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদের চেয়ে উন্নত ছিল। জানা মতে, এ ধরনের আদি মসজিদ হলো দিনাজপুর শহরের গোপালগঞ্জ মসজিদ (১৪৬০)। এ ধরনের মসজিদ বাংলায় অতি পরিচিত ছিল। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অংশে এ রীতি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। বাংলায় এ ধরনের মসজিদের অনেক উদাহরণ আছে যেমন, গৌড়ের চামকাটি মসজিদ (১৪৭৫) ও লট্টন মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯), পটুয়াখালীর মসজিদবাড়ি মসজিদ (১৪৬৫), সিলেটের শঙ্করপাশা মসজিদ (১৪৯৩-১৫১৯), পাবনার নবগ্রাম মসজিদ (১৫২৬) এবং টাঙ্গাইলের আতিয়া মসজিদ (১৬০৯)।
মুসলিম বিশ্বের স্থাপত্যিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সেলজুগ ও আদি অটোম্যানদের শাসনাধীনে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় নির্মিত এক ধরনের জনপ্রিয় মসজিদ রীতির সাথে খনিয়াদিঘির মসজিদের মিল আছে। মনে হয়, এ দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সেলজুগ শিল্পী ও কারিগরগণ যারা মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে অভিবাসী হিসেবে দূরবর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তাদের মাধ্যমে মসজিদ স্থাপত্যের এ রীতির প্রভাব বাংলায় এসে পড়েছিল। [এম.এ বারি]
গ্রন্থপঞ্জি Abid Ali, Memoirs of Gaur and Pandua, Calcutta. 1931; Bangladesh Archaeology, I, Department of Archaeology & Museums, Dhaka, 1979; G Michell (ed), The Islamic Heritage of Bengal, Paris, 1984; ABM Husain (ed), Gawr-Lakhnawti, Dhaka, 1997.