কোম্পানি অ্যাক্ট, ১৯৯৪
কোম্পানি অ্যাক্ট, ১৯৯৪ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ব্যবসা বানিজ্য সংক্রান্ত আইনি কাঠামো প্রথমে যুক্তরাজ্যে বা গ্রেট ব্রিটেনে উদ্ভব হয়। একাদশ থেকে এয়োদশ শতাব্দী সময়কালে ওই দেশের বণিকরা যৌথভাবে ‘বনিক সংঘ’ (মার্চেন্ট গিল্ড) নামে সমিতি গঠন করে, যার উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা। ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সংঘগুলো রাজকীয় সনদ লাভ করত। প্রাপ্ত সনদের শর্তাবলি অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। এ থেকে বলা যায় যে, বনিক সংঘ ছিল কোম্পানি গঠনের বর্ধিত প্রক্রিয়া। মূলত এ কোম্পানিগুলো ছিল বানিজ্যিক কোম্পানি।
সপতদশ শতাব্দীতে এ ধরনের কোম্পানি বৈদেশিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এদের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, লেভান্ট কোম্পানি এবং রাশিয়া কোম্পানি। এ সব কোম্পানি রাজকীয় সনদের মাধ্যমে নিবন্ধিত ছিল। কালের বিবর্তনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বহির্বানিজ্যের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে রাজকীয় সনদের মাধ্যমে দেশ শাসনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার লাভ করে। এর ফলে নির্দিষ্ট অধিক্ষেত্রে এ কোম্পানি রাষ্ট্রের পক্ষে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী হয়ে রাজনৈতিক সরকারের রূপ ধারন করে।
ঐ সময় ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে যৌথ মূলধন বিনিয়োগ করার প্রথা একটি সমান্তরাল ধারা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলশ্রুতিতে যৌথ মূলধন কোম্পানির ধারণা ও প্রথা কোম্পানি আইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পরিগণিত হয় যা পরবর্তীকালে পাবলিক বা প্রাইভেট সীমিত মূলধন কোম্পানির উৎস হিসাবে পরিচিত।
সপতদশ শতাব্দীর পরে ব্রিট্রিশ পার্লামেন্ট বানিজ্যিক কোম্পানি পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো প্রনয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বেআইনী বা ভূয়া বানিজ্যিক কোম্পানির অস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধিই এর মূল কারণ। রাজকীয় সনদ ও পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রাপ্তি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ছিল বলে অনেক বনিকই অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোম্পানি গঠন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের অস্বাভাবিক ধারা প্রতিরোধকল্পে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭২০ সালে দ্য বাবল আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন ও চালু করে। কাঠামোগত দুর্বলতার জন্য এ আইনটি কার্যকর করা দুরুহ ছিল এবং যে উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণীত হয় তা অর্জন করা সম্ভব হয় নি।
এ সমস্যা উত্তরণের জন্য আইনটিকে বাতিল করে যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানীকে সনদ জারীর ক্ষমতা প্রদান করা হয়। শর্ত ছিল এই যে, কোম্পানির সদস্যদের দায় স্বীয় বিনিয়োগকৃত মূলধনের মধ্যেই সীমিত থাকবে। এ ধরনের শর্ত থেকেই সীমিত দায় কোম্পানির উদ্ভব হয়। এ সংক্রা্ন্ত ১৮৩৪ সালের আইনে বানিজ্যিক কোম্পানিগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল।
প্রচলিত আইনের উৎকর্ষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বোর্ড অব ট্রেডের প্রেসিডেন্ট গ্ল্যাডস্টোন ১৮৪৪ সালে দ্য জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানিজ আইন (১৮৪৪) প্রনয়ন করেন। আধুনিক কোম্পানি আইনের ভিত্তি হিসাবে এ আইনটিকে গণ্য করা হয়ে থাকে। অনুরূপ একটি আইন ১৮৫৭ সালে ভারতেও চালু করা হয়। ১৮৫৭ সালেই সর্বপ্রথম ‘সীমিত দায়’ ধারণা ভারতে চালু হয়। পরবর্তীকালে ১৮৬২, ১৮৬৬ ও ১৮৮২ সালেও প্রচলিত আইনের পরিবর্তন হয়। ১৮৮২ থেকে ১৯১৩ সালের মধ্যে একাধিকবার আইনটি সংশোধিত হয়ে ১৯১৩ সালে কোম্পানি গঠন ও পরিচালনা সংক্রা্ন্ত আইনটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
১৯১৩ সালের আইনটি স্বাধীনতাউত্তরকালেও বাংলাদেশে বলবৎ থাকে। ১৯৭৭ সালে সরকার একটি আইন সংস্কার কমিটি গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত কোম্পানি আইনের আধুনিকীকরন। ১৯৯৪ সালে একটি নতুন কোম্পানি আইন প্রণীত হয় যার ফলে ১৯১৩ সালের আইন বাতিল হয়।
এ আইনের ভূমিকায় বলা আছে যে, ইতিপূর্বে প্রণীত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনসমূহ সুসংহত ও সংশোধন করা প্রয়োজন ও জরুরী। নতুন আইনটিতে মোট বারো অংশ ও বারো তফসিল রয়েছে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোম্পানি অর্থ এ আইনের অধীনে গঠিত ও নিবন্ধিত কোম্পানি। এ আইনে সার্বিকভাবে দুই ধরনের কোম্পানিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যথা সীমিত অথবা অসীমিত দায়সম্পন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট কোম্পানি। যে সমস্ত কোম্পানি প্রাইভেট ধরনের নয় সেগুলো পাবলিক কোম্পানি হিসাবে গণ্য। তবে এ সমস্ত কোম্পানিকে আইনের অধীনে নিবন্ধিত (Incorporated) হতে হবে। প্রাইভেট কোম্পানিকে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে; যথা ১. স্বীয় অংশ (Share) অন্যকে দিতে হলে আইনে প্রদত্ত শর্তাবলি মানতে হবে, ২. কোম্পানির মূলধনের জন্য জনসাধারণ থেকে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার আহবান করা যাবে না এবং ৩. কোম্পানির সর্বমোট সদস্য সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক হবে না।
কোম্পানি গঠন ও নিবন্ধনের বিষয়ে প্রধানতঃ পাঁচটি শর্ত বিদ্যমান। প্রথম, কোনো অংশীদারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা সমিতি এ আইনের বা অন্য কোনো আইনের বলে গঠিত ও নিবন্ধিত না হলে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করার বিধিনিষেধ; দুই, মুনাফার জন্য অংশীদারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা সমিতি এ আইনের অধীনে বা অন্য কোনো আইন দ্বারা গঠিত না হলে তা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না যার মোট সদস্য বিশের অধিক হয়। তিন, শেষোক্ত শর্ত যুগ্ম পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে দুই বা ততোধিক পরিবার অংশীদারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সমিতি বা কোম্পানি গঠন করলে অন্যান্য শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে গননা করা যাবে না। চার, উপর্যুক্ত শর্তাবলি অমান্য করে ব্যবসা পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের পূর্ণ দেনা পরিশোধ করতে হবে। পাঁচ, এ ছাড়া শর্তভঙ্গকারী ব্যবসায়ীদের শাস্তি হবে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা।
পাবলিক বা প্রাইভেট কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা হতে হবে সাত বা তার অধিক। প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক। প্রতিষ্ঠানটি সীমিত দায় বা অসীমিত দায় সম্পন্ন কিনা তা স্পষ্ট ভাষায় ওই কোম্পানির সংঘস্মারকে উল্লেখ করতে হবে।
প্রস্তাবিত কোম্পানি গঠন তিন ধরনের হতে পারে। এক, শেয়ার দ্বারা সীমিত দায়সম্পন্ন অর্থাৎ কোম্পানির সংঘস্মারকে প্রত্যেক সদস্যের শেয়ার সংখ্যা ও মূল্যভিত্তিক দায় সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারন, যাতে মূল্য পরিশোধিত হয় নি তাও অর্ন্তভুক্ত থাকবে। অথবা দুই, সীমিত দায় পরিশোধকল্পে গ্যারান্টি প্রদান যা সংঘস্মারকে উল্লেখ করতে হবে। এবং এ ধরনের দায় পরিশোধের জন্য নির্ধারিত দায়ের সমান মূল্য সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে পরিশোধিত হবে অথবা তিন, অসীমিত দায়সম্পন্ন কোম্পানি অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে দায়ের সীমা নির্ধারিত হয় নি। এ ছাড়া সংঘস্মারকে আইনের দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য শর্তাবলিরও উল্লেখ থাকবে। কোম্পানির সংঘস্মারক পরবর্তী সময়ে রদবদলের প্রয়োজন হলে আইনের দ্বারা নির্ধারিত শর্তাবলি প্রযোজ্য। এ জন্য আদালতকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
আইনে দাতব্য বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে ‘সীমিত দায়’ কথাটি ব্যবহার না করার বিষয়ে বিধান বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা একমাত্র সরকারই প্রয়োগ করতে সক্ষম। কিছু বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানও এ আইনে নিবন্ধিত।
এ আইনে শেয়ার-মূলধন, সদস্যদের তালিকা, শেয়ারের হস্তান্তর ও এর প্রত্যয়নপত্রে আরও বহুবিধ বিষয়ের পদ্ধতিগত দিক-নির্দেশনা রয়েছে। শেয়ার-মূলধনের পরিমাণ হ্রাস করতে হলে আদালতের অনুমতি প্রয়োজন। এ ছাড়া রয়েছে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সভা পরিচালনা, পরিচালকদের নিয়োগ এবং এদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়াদি। বিকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়েও আইনে বিধান রয়েছে।
সরকারি কার্য সম্পাদন নীতিমালাভুক্ত মন্ত্রনালয়ের কার্যবন্টনের বিষয় অনুযায়ী এ আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের উপর ন্যস্ত। মন্ত্রনালয় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি দপ্তরের নিবন্ধকের মাধ্যমে আইন পরিচালনা করে। এ আইনের বলে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধককে যাবতীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রণীত সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন আইনে (আইন নং ২১, ১৮৬০) জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধকের সংজ্ঞা বিদ্যমান। এ আইনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওই একই অর্থে নিবন্ধককে গণ্য করা হবে। পরিশেষে একথা বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে, আনডিজায়ারেবল কোম্পানিজ অ্যাক্ট, ১৯৫৮, কোম্পানিজ (ফরেন ইন্টারেষ্ট) অ্যাক্ট, ১৯১৮, কোম্পানিজ প্রফিট (ওয়ার্কার্স কমপেনসেশন) অ্যাক্ট, ১৯৬৮ এবং পার্টনারশিপ অ্যাক্ট, ১৯৩২ সংক্রা্ন্ত আইনগুলোও উল্লেখ করা প্রয়োজন। কিন্তু কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ এর বিস্তৃতি ও উদ্দেশ্য উপর্যুক্ত আইনগুলোর তুলনায় অধিকতর বলে গণ্য করা যায় এবং অন্যান্য আইনের প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি এ আইনে সুসংহত করা হয়েছে। [এ.এম.এম শওকত আলী]