কোটালিপাড়া

কোটালিপাড়া  প্রাচীন স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের একটি দুর্গ নগর; চন্দ্রবর্মণকোট নামেও এর পরিচিতি ছিল। গোপালগঞ্জ জেলা শহরের ২৮ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে ঘাগর নদীর তীরে অবস্থিত এ দুর্গ নগরই সম্ভবত সমাচারদেবের ঘুঘ্রাহাটি গ্রামে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উল্লিখিত চন্দ্রবর্মণকোট। জৈমস ওয়াইজ কোটালিপাড়াকে গ্রিক বিবরণীর গঙ্গারিডাই রাষ্ট্রের রাজধানী বলে মনে করেছিলেন। তবে স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের সাথে এর সম্পৃক্ততা অধিক যুক্তিসঙ্গত।

সাত শতকে দক্ষিণবঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গের একাংশ এবং পূর্ববঙ্গ নিয়ে স্বাধীন ও পরাক্রমশালী বঙ্গ রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচটি এবং বর্ধমান অঞ্চলে আবিষ্কৃত একটি সহ মোট ছয়টি  তাম্রশাসন-এ তিনজন স্বাধীন রাজার নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন গোপচন্দ্র (আনু. ৫৪০ খ্রি.), ধর্মাদিত্য (আনু. ৫৭০ খ্রি.) এবং সমাচারদেব (ছয় শতকের শেষভাগ)। আবিষ্কৃত তাম্রফলকগুলি এবং কুরপালা গ্রামে প্রাপ্ত কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা হতে জানা যায় যে, এঁরা সকলেই মহারাজাধিরাজ, নৃপাধিরাজ, অধিমহারাজ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। কোটালিপাড়া এ রাজাদেরই শাসনকেন্দ্র ছিল।

কোটালিপাড়া দুর্গ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিস্মৃতপ্রায় চন্দ্রবর্মণকোট অতীতে দুটি অংশে বিভক্ত ছিল; প্রথমটি মূল দুর্গনগর এবং দ্বিতীয়টি উপনগর। মূল দুর্গটি আয়তাকারে নির্মিত এবং এটি প্রায় ১৭.৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এটি দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় ৪.৭৫ কিমি এবং প্রস্থে ৪ কিমি। দুর্গের বাইরের প্রাচীর ঘিরে যে কৃত্রিম প্রতিরক্ষা পরিখা ছিল তা আজো দৃশ্যমান। চন্দ্রবর্মণকোটের উপনগরটি খুব সম্ভব দুর্গনগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ঘাগর নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল। এ অঞ্চলে গুগ্রাহটি, কুরপালা, গুয়াখোলা এবং মাঝবাড়ি নামক গ্রামগুলি থেকে উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলাধীন কোটালিপাড়া অঞ্চলকে ছয় শতকের একাধিক তাম্রশাসনে ‘নব্যাবকাশিকা’ (নবসৃষ্টভূমি) বলে অভিহিত করা হয়েছে। ছয় শতকে এ ‘নব্যাবকাশিকা’ সমৃদ্ধ জনপদ এবং নৌবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল বলে মনে হয়।

গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (আনু. ৩৮০ খ্রি.) এবং স্কন্ধ গুপ্তের (আনু. ৪৫৫-৪৬৭) কতকগুলি স্বর্ণমুদ্রা কোটালিপাড়ার গুয়াখোলা গ্রামের সোনাকান্দি মাঠে ১৯০৮ সালে ভূমি জরিপের সময় পাওয়া যায়। কোটালিপাড়ায় কৃষিকাজের অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় এবং এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল বলে অনুমিত হয়। কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত ছয় শতকের দুটি তাম্রশাসনে দেখা যায়, এখানে নৌবাণিজ্যেরও একটি কেন্দ্র ছিল। ফলে এখানে নৌ-ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। তাম্রশাসনে নৌদন্ডক, নবাতক্ষেণী, নৌযান, নৌঘাট প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার এরই ইঙ্গিত দেয়।

কোটালিপাড়ায় একটি সূর্যমূর্তি পাওয়া গেছে। এর উল্লেখ কিছু সাহিত্য কর্মেও দেখা যায়। কোটালিপাড়া তথা চন্দ্রবর্মণকোট সম্পর্কে সকল তথ্য এখনও সম্পূর্ণভাবে উদঘাটন করা যায়নি। তবে প্রাপ্ত প্রত্ন সামগ্রী অত্র অঞ্চলের সুপ্রাচীনতার সাক্ষ্য দেয়।  [জেসমিন সুলতানা]