কৃষি সম্প্রদায়, প্রাথমিক যুগ

কৃষি সম্প্রদায়, প্রাথমিক যুগ  বিগত চার দশক ও তারও কিছু আগে থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্লাইস্টোসিন যুগের মাঝামাঝি ও শেষ (বর্তমান থেকে ০.৬-০.১ মিলিয়ন বছর পূর্বে) দিকে বাংলার একটি পৃথক সংস্কৃতি রয়েছে। ‘ম্যাক্রো’ লেবেল গবেষণায় দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী বিহার ও উড়িষ্যার রয়েছে বাংলার সমরূপ প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি। কিন্তু ‘মাইক্রো’ লেবেল গবেষণা প্রকাশ করে, বাংলার একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল যা কিনা বাংলার পরবর্তী সংস্কৃতি সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রেখেছে। অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় বাংলার পশ্চিমাংশে বার্মা-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রাপ্ত ধারাল অস্ত্র, নবপ্রস্তরযুগীয় হাত কুঠার, বাটালি ও আরও অন্যান্য প্রস্তরীভূত কাঠের দ্রব্যাদি এ অঞ্চলের প্রস্তর যুগের গবেষণায় নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। বাংলা বলতে যদিও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ বুঝায়, তথাপি প্রাথমিক কৃষি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব এর দক্ষিণপশ্চিম অংশেই খুঁজে পাওয়া যায়।

পান্ডু রাজার ঢিবি, ভরতপুর ও তমলুকের তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির নিম্ন স্তর থেকে নবপ্রস্তরযুগীয় পাথরের কুঠারের আকস্মিক আবিষ্কারকে কৃষিভিত্তিক তাম্রপ্রস্তরযুগীয় অর্থনীতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। ফলে বাংলায় নবপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির অকাট্য প্রমাণের অভাবে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতিই বাংলার প্রাচীন কৃষি ভিত্তিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে বলে গণ্য করতে হয়। তারা ৮৬০২৩-৮৮০২২ উত্তর অক্ষাংশ ও ২৪০১৫-২৩০৫৮ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পশ্চিম সমতল হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চল পশ্চিমের পাহাড়ি মালভূমি থেকে পূর্বে গঙ্গা/ভাগীরথী পর্যন্ত এবং উত্তরে গঙ্গা/ পদ্মা থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রধানত অজয়/ দামোদর/ কসাই/ রূপনারায়ণ এবং ময়ূরাক্ষী নদী বিধৌত বাংলার এ অঞ্চলটিতে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বাংলায় প্রথম কৃষি সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা লালগড় ফরমেশনের লালমাটি এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে কালো ও লাল মৃৎপাত্রের আবিষ্কার পরবর্তী ঐতিহাসিক যুগের সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এর পরপরই ১৯৬২ সালে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য পরিচালিত হয় এবং এর পর থেকে এর আশেপাশের আরও কিছু প্রত্নস্থলে খননের ফলে বেশ কিছু কালো ও লাল মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে।

পান্ডুরাজার ঢিবিতে খননকার্য বাংলার প্রাথমিক যুগের কৃষি সম্প্রদায়ের ওপর আমাদের ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করেছে। শুরুতে এ সংস্কৃতিকে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় বলে উল্লেখ করা হলেও বর্তমানের গবেষণায় এ নামকরণ ঠিক মতো হয় নি বলে মনে হয়, বিশেষ করে তাম্রপ্রস্তরযুগীয় স্তর থেকে বিপুল পরিমাণ লৌহ দ্রব্যাদি এবং মূল্যবান ধাতু, ধাতুমল ও মসৃণ হাতিয়ার (finished tools) আবিষ্কারের ক্ষেত্রে। এখন এ স্তরটিকে শুধুই কালো ও লাল মৃৎপাত্রের সংস্কৃতি বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, অন্তত যতদিন না পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্ট নাম স্থির করা হয়।

হাঁড়ের হাতিয়ার, পাণ্ডুরাজার ঢিবি

১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বাংলায় কৃষিই ছিল জীবিকার প্রধান ভিত্তি। সব মিলিয়ে প্রায় ৭৮টি তাম্রপ্রস্তরযুগীয় বা কালো ও লাল মৃৎপাত্রের প্রত্নস্থল শনাক্ত করা হয়েছে। প্রত্নস্থলগুলি তিনটি ভিন্ন মৃৎ স্তরে বিন্যস্ত। বিন্যাসের প্রকৃতি অনুসারে সর্বাধিক সংখ্যক প্রত্নস্থল পাওয়া যায় লাল মাটি (Lalgarh Formation) অঞ্চলে, এরপর আছে পুরানো পললভূমি (Sijua Formation) এবং সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে নতুন পললভূমিতে (Daintikri Formation)| প্রত্নস্থলগুলির বেশিমাত্রায় প্রাধান্য দেখা যায় অজয়/ দামোদর নদের আশে পাশে লাল মাটি ও পুরানো পললভূমিতে। মুর্শিদাবাদের খেরুর হলো এ সংস্কৃতির উত্তর সীমান্ত আর মেদিনীপুরের নাটশাল বা তমলুক এর দক্ষিণ সীমা। এ সংস্কৃতির পূর্ব সীমা পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলি পর্যন্ত বিস্তৃত এবং পশ্চিমে এটির অস্তিত্ব পাওয়া যায় পুরুলিয়ার দেউলতরন পর্যন্ত। কোনো কারণে, যদিও এটি আমাদের কাছে এখনও পরিষ্কার নয়, প্রাথমিক যুগে কৃষি সম্প্রদায়টি ভাগীরথীর পূর্ব দিকে আর বসতি বিস্তার করে নি। যাহোক, ভাগীরথীর পশ্চিম পার্শ্বের ৭৮টি প্রত্নস্থলই এ এলাকার গুরুত্বের কথা ঘোষণা করে।

খননকৃত স্থল ৭৮টি প্রত্নস্থলের মধ্যে ১৪টি খনন করা হয়েছে। এ খনন বাংলার কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের জীবন ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তি ও গুরুত্বের ওপর তথ্য সরবরাহ করেছে। খননকৃত প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে তমলুক, ভরতপুর, মহিষদল, হরইপুর, তুলসীপুর ও নানূর-এ খনন কার্য পরিচালনা করেছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া; পান্ডুরাজার ঢিবি, বানেশ্বরডাঙ্গা ও সিজুয়াতে খনন করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টেট ডিরেক্টরেট অব আর্কিওলজি; মঙ্গলকোট, দিহার ও পোখরনায় খনন পরিচালিত হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক; হাতিগরায় খনন পরিচালনা করে ডিপার্টমেন্ট অব এ.আই.এইচ.সি ও বিশ্বভারতীর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং বাহিরি খনন করে দিল্লি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ। মঙ্গলকোটে খননের পর যে সমস্যাটির উদ্ভব হয়, তা এর পর আর গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা হয় নি। সমস্যাটি ছিল তাম্রপ্রস্তরযুগ থেকে প্রাথমিক ঐতিহাসিক যুগে রূপান্তর সম্পর্কিত। মঙ্গলকোটে খননের ফলে প্রাপ্ত তথ্য প্রতীয়মান করে কিভাবে তাম্রপ্রস্তরযুগ থেকে, অথবা বাংলার প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়, একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল পাড়ি দিয়ে ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করেছে। এ সমস্যা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য প্রত্নস্থল খননের সময় গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করা হয় নি। সর্বোপরি সবগুলি খননই পরিচালিত হয়েছে উলম্ব পদ্ধতি অবলম্বনে, ফলে এ অঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে খুব কমই জানার সুযোগ হয়েছে।

চ্যানেল স্পাউটেড গামলা, পাণ্ডুরাজার ঢিবি

প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে ভরতপুর, মহিষদল, তুলসীপুর, হরইপুর, দিহার, হাতিগড়া, বাহিরি ও সিজুয়া অবস্থিত লাল মাটি (upper Laggard Formation) অঞ্চলে; অন্যদিকে পান্ডুরাজার ঢিবি, বানেশ্বরডাঙ্গা, মঙ্গলকোট, পোখরনা ও নানূর অবস্থিত পুরানো পললভূমিতে (Sijua Formation)। শুধু তমলুক নতুন পললভূমিতে (Daintikri Formation) অবস্থিত। সংস্কৃতির বিভিন্ন স্তরের পুরুত্ব ১ মিটার থেকে ২.৫ মিটারের মধ্যে সীমিত। শুধু পান্ডুরাজার ঢিবি বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাম্রপ্রস্তরযুগীয় দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে অকর্ষিত মাটিতে। পান্ডুরাজার ঢিবিতে তাম্রপ্রস্তরযুগের স্তরের নিচে একটি নব্যপ্রস্তরযুগীয় স্তরের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয়।

লাল মাটি অঞ্চলের প্রত্নসামগ্রী বেশিরভাগ খননকৃত প্রত্নস্থলই বীরভূমের পশ্চিমাংশ, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের লাল মাটি অঞ্চলে অবস্থিত। খননের মাধ্যমে এটি প্রতীয়মান যে, সাংস্কৃতিক স্তরগুলি ১ থেকে ২.৫ মিটারের মতো পুরু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খননকারীরা দুটি সাংস্কৃতিক স্তরকে আলাদা করেছেন প্রত্নসামগ্রীর ধাতু সম্বন্ধীয় গুরুত্বকে বিবেচনা না করেই, বরং আলাদা করেছে লৌহ দ্রব্যের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ভিত্তিতে। সিরামিকের যে সব সামগ্রী পাওয়া গেছে তা ছিল কালো-লাল মৃৎপাত্র, লাল মৃৎপাত্র, কালো মৃৎপাত্র, বাফ মৃৎপাত্র ও ধূসর মৃৎপাত্র ইত্যাদি। তবে এগুলি মানের দিক থেকে, আকৃতিতে বা এদের গায়ের চিত্রকর্মের দিক থেকে তেমন উন্নত ছিল না। উপরের স্তরে বা দ্বিতীয় স্তরে দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে অবক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট যেমন সিরামিক দ্রব্যাদিতে এই অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়েছে এদের অমসৃণতা ও অসূক্ষ্মতার কারণে। এর পর অর্থনৈতিক উন্নয়নেও স্থবিরতা লক্ষ করা যায়। এ সময়কার শিল্প কর্ম ছিল চ্যানেল স্পাউটেড গামলা, সমান তলা বিশিষ্ট গামলা, উচু কান্দা যুক্ত পাত্র, উপরের দিকে উল্টানো ক্যারিনেটেড পাত্র, কলস, বেসিন ও হাঁড়ি ইত্যাদি। লাল-কালো ও লাল মৃৎপাত্রে জ্যামিতিক চিত্রাঙ্কন ও বিমূর্ত শিল্প চোখে পড়ে। রঙ ছিল হয় সাদা অথবা কালো। পাত্রের তলায় প্রাপ্ত শুকনো ধান থেকে এটি প্রমাণ হয় যে, ধানই ছিল প্রধান শষ্য। এই ধানকে ‘ওরাইজা সাটিভা’ (Oryza Sativa) বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে ধানের উৎপাদন জনগোষ্ঠীর চাহিদা কতখানি মেটাতো তা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। কারণ ভরতপুর ও মহিষদলের নিম্ন স্তরে প্রাপ্ত মাইক্রোলিথ (ক্ষুদ্রাকৃতির প্রস্তর হাতিয়ার) ও হাড়ের অস্ত্রের বিপুল সংগ্রহ দেখে এটি স্পষ্ট হয় যে, তখনও শিকার ছিল এ সম্প্রদায়ের জীবিকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। অধিকন্তু ভরতপুর থেকে বন্যপশু ও গৃহপালিত পশুর হাড়ের বিপুল পরিমাণে অস্ত্র পাওয়া গেছে। হাড়ের অস্ত্রের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, এদের ৭১.৯৩% হলো গৃহপালিত পশু যেমন, মহিষ, কুঁজওয়ালা গবাদি পশু, ছাগল ইত্যাদির এবং ২৭.৬১% হলো বন্য প্রাণীর। এ থেকে পরিষ্কার যে, তখনও এ অঞ্চলের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য ব্যাপক আকারে পশুপালন করত। উচ্চ প্রটিনযুক্ত প্রাণীখাদ্যই ছিল তাদের খাদ্যের প্রধান উপাদান। তার মানে এ যে, কৃষি ছাড়াও পশু পালন ছিল তাদের জীবিকার অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

তাম্র দ্রব্যাদি, পাণ্ডুরাজার ঢিবি

এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধাতু বিদ্যার (তামা অথবা লোহা) প্রভাব ছিল সামান্য। প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে তামা ও লোহা সহজ লভ্য হওয়া সত্ত্বেও এখানকার মানুষ এর যথার্থ ব্যবহার করতে সক্ষম হয় নি। আর এ জন্যই অর্থনীতিতে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যায়। নগরভিত্তিক কোনো আধুনিক সামগ্রী এখানে খুঁজে পাওয়া যায় নি। মাটির পাত্রে চিত্রাঙ্কন ও ধাতুবিদ্যায় আর কোনো উন্নয়ন চোখে পড়ে না। প্রকৃতপক্ষে, এ অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসে অর্থনীতি মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। অর্থনীতির এ স্থবিরতার প্রধান কারণ হলো সম্ভবত মাটির কম উর্বরতা, আর তার সাথে যুক্ত স্বল্প বারিপাত। স্বাভাবিকভাবেই এরূপ পরিস্থিতিতে কেউই ঘরে বসে করার মতো শিল্প বা কারুকলা পেশায় উন্নতি আশা করতে পারে না। সবকিছু বিচার করে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, অঞ্চলটিতে একাধিক জীবিকার মানুষ বসবাস করত। ফলে তাদের গড়ে তোলা কৃষি ও শিকার ভিত্তিক এ সভ্যতা তাদের চাহিদা অনুযায়ী ভাল হয়ে থাকলেও তা পরবর্তী উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পরিমিত সম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিক যুগের অব্যবহিত পূর্বে বা পরেই এ অঞ্চলে কৃষি ভিত্তিক এ সম্প্রদায়ের অবলুপ্তি ঘটে।

ফুলদান, বানেশ্বরডাঙ্গা

পুরানো পললভূমি এলাকার প্রত্নসামগ্রী এ অঞ্চলে খননকৃত প্রত্নস্থলগুলি হলো পান্ডুরাজার ঢিবি, মঙ্গলকোট, বানেশ্বরডাঙ্গা এবং পোখরনা। এখানে সাংস্কৃতিক স্তরগুলি ১.৫ মিটার থেকে ২.৫ মিটার পুরু। যদিও ভিন্ন ভিন্ন প্রত্নস্থলে বিভিন্ন স্তরগুলির কাল নিরূপণে ঐক্য লক্ষ করা যায় না, তথাপি প্রত্নসামগ্রীতে ঐক্য বিদ্যমান। সিরামিক সামগ্রীর মধ্যে কালো-লাল মৃৎপাত্র, কালো মৃৎপাত্র, লাল মৃৎপাত্র, ধূসর মৃৎপাত্র, বাফ মৃৎপাত্র, চকলেট মৃৎপাত্র ইত্যাদি বিদ্যমান। বিভিন্ন আকারের পাত্রের মধ্যে রয়েছে চ্যানেল স্পাউটেড, টিউলিপ আকৃতি বিশিষ্ট, উচু কান্দা বিশিষ্ট ইত্যাদি; স্ট্যান্ডের উপর গামলা, বিভিন্ন আধার, বেসিন, বৃহৎ পানপাত্র (Beakers), ফুলদানি, ক্ষুদ্রাকৃতির পাত্র ইত্যাদি। চিত্রশিল্প এবং সে সাথে এচিং ছিল সাধারণত কাল মৃৎপাত্রের ওপর এবং এইগুলি ছিল বেশ উঁচুমানের এবং অনেকটা বিশদাকারের। এ এলাকার বসতি ছিল লাল মাটি এলাকার বসতির চেয়ে অনেক বড়। এ সভ্যতার অর্থনৈতিক বিকাশে ধাতুবিদ্যার প্রভাব ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও ব্যাপক। পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে লোহার কাস্তে এবং মঙ্গলকোট থেকে আবিষ্কৃত কুঠার ও বাটালি প্রমাণ করে কৃষি অর্থনীতিতে এর ভূমিকা।

এ অঞ্চলে ক্ষুদ্রাকৃতির প্রস্তর হাতিয়ার (Microliths) একেবারে অনুপস্থিত, আর পান্ডুরাজার ঢিবি বাদে হাড়ের ব্যবহারও এখানকার অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকাই রাখে নি। আর পশু দেহের অবশিষ্ট লালমাটি এলাকার মতো অত বেশি নয়। তাই এ থেকে বলা যায়, এখানকার মানুষ পশুচারণের তুলনায় অনেক বেশি মনযোগী ছিল কৃষিকাজের প্রতি। এখানকার মাটি ছিল ধান চাষের জন্য অত্যন্ত উর্বর এবং বৃষ্টিপাতের হারও ছিল মোটামুটি ভাল। একই সাথে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়ন যেমন, সৃষ্টিশীল শিল্প, সিরামিক দ্রব্যাদি, ধাতুপ্রযুক্তি, পাথরের গুটিকা তৈরি, হাড়ের দ্রব্যাদি তৈরি প্রভৃতিকে বলা যেতে পারে কৃষির অতিরিক্ত উৎপাদন। প্রকৃতপক্ষে, পুরানো পললভূমির (Sijua Formation) মানুষেরা যে ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিল তা পরবর্তীকালে অত্যন্ত সফল হয়। এখানকার অধিবাসীরা ছিল দুটি ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। একদিকে তাদের কৃষি পরিবেশ যেমন গড়ে তুলেছিল মাটি-মানুষের সম্পর্ক, যা আগে কখনই এভাবে গড়ে ওঠে নি অন্যদিকে তাদের অর্ধ-নগর পরিবেশ তাদের বাধ্য করেছিল নগর  চাহিদার যোগান দিতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত বাড়তি জনসংখ্যার চাপে এখানকার বসতি বৃদ্ধি পায়। ফুলদানি, বৃহৎ পানপাত্র, অল্পমূল্য পাথরের পুঁতি, গা ঘষার সামগ্রী, হাতির দাঁতের চিরুনি, লকেট, বালা, কানের দুল, সুরমার কাঠি ইত্যাদি নাগরিক জীবনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে মঙ্গলকোট ও পোখরনার মতো প্রায়-নগর (Semi-urban) কেন্দ্রগুলি ঐতিহাসিক যুগের প্রথম পর্যায়ে সম্পূর্ণ নগরে উন্নীত হয়। তবে নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে পান্ডুরাজার ঢিবি ও বানেশ্বরডাঙ্গা নগর কেন্দ্রে উন্নীত হতে ব্যর্থ হয়।

লৌহ দ্রব্য, পাণ্ডুরাজার ঢিবি

নতুন পললভূমি এলাকার প্রত্নসামগ্রী তৃতীয় গ্রুপের প্রত্নস্থলগুলি নিম্ন বঙ্গের সমতল বদ্বীপ অঞ্চলে, বিশেষকরে ভাগীরথী/ রূপনারায়ণ নদীর তীরে। এখানকার মাটি একটি স্থিতিশীল কৃষি অর্থনীতির জন্য ছিল মোটামুটি কার্যকর। এখানকার একমাত্র খননকৃত কেন্দ্র হলো তমলুক বা তাম্রলিপ্তি। ১৯৭৩-৭৪ সালে পরিচালিত খননের মাধ্যমে এখানে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক স্তরের পরিচয় মেলে, যার মধ্যে প্রথম স্তরটি হলো সর্বপ্রাচীন।  স্তরটি কালো-লাল মৃৎপাত্র সম্বলিত। এখানকার সিরামিক শিল্প ছিল বিভিন্ন আকার ও আকৃতির লাল-কালো মৃৎপাত্র, লাল মৃৎপাত্র, কালো মৃৎপাত্র, বাফ মৃৎপাত্র, ধূসর মৃৎপাত্রে সমৃদ্ধ। পাত্রের গায়ে অঙ্কিত চিত্রশিল্পও বেশ সমৃদ্ধ ও বিশদ। হাড়ের দ্রব্যাদির একটি সমৃদ্ধ স্তরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। দক্ষিণ বাংলার বিশাল অংশ জুড়ে ছিল এ অঞ্চল এবং নদী ও স্থলপথ দ্বারা দূরবর্তী অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত ছিল। এখানকার মানুষেরা ছোটনাগপুরের সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকার সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতো তাদের বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহের জন্য এবং তাদের নিজেদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য বিতরণেও ওই একই পথ ব্যবহার করতো। ফলে এরূপ বাণিজ্যে গড়ে ওঠা সম্পদ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহূত হয়। এ অর্থনৈতিক উন্নতি তাদের বস্ত্তগত সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়। খ্রিস্টীয় তিন শতকের মধ্যে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ীয় অঞ্চলের একটি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় উভয় অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে। পরবর্তীকালে তাম্রলিপ্তি সমগ্র পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে একটি আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে। এ পরিবর্তন এবং উক্ত দুই দূরবর্তী অঞ্চলের মধ্যে যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল তা সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।  [অশোক দত্ত]

গ্রন্থপঞ্জি  A Datta, ‘Chalcolithic Culture in West-Bengal - A study on Settlement And Transition’, in A Ray and S Mukherjee (ed), Historical Archaeology of India, New Delhi, 1988; Black and Red Ware Culture in West-Bengal, Delhi, 1995; ‘Bengal and South-East Asia – Early Trade and Cultural Contacts’, Journal of Bengal Art, No. 4, Dhaka,1998.