কুমিল্লা মডেল
কুমিল্লা মডেল কুমিল্লা জেলা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত প্রশিক্ষণ-গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) থেকে উদ্ভূত ও বিকশিত একটি গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগ। উদ্ভবস্থলের নামানুসারে এ উদ্যোগটি কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিত। কুমিল্লা মডেলের প্রবর্তক এবং একাডেমীর প্রথম পরিচালক আখতার হামিদ খান তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণের নীতি ও সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন এলাকায় এটি প্রয়োগের ধারণা ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ১৯৫৯ সালের শুরু থেকে কয়েকটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এসব প্রকল্প প্রবর্তনের পেছনে দুধরনের উদ্দেশ্য ছিল: প্রথমত, একাডেমীতে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বাস্তব জীবন সম্পর্কে শিক্ষাদানের পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং দ্বিতীয়ত কর্মসূচি/প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মডেল উদ্ভাবন, যা দেশের অন্যত্রও বাস্তবায়ন করা যায়। প্রকল্পগুলোর দিকনির্দেশনা ও কার্য পরিচালনায় পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রণীত নীতিমালা ও কৌশল পাইলট প্রকল্পসমূহের উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করে এবং ফলত একটি গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগ সৃষ্টি হয়। এ উদ্যোগ কুমিল্লা উদ্যোগ, কুমিল্লা মডেল, কুমিল্লা প্রোগ্রাম, কুমিল্লা এক্সপেরিমেন্ট ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
কুমিল্লা মডেলের বিবর্তনের কয়েকটি পদক্ষেপ রয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ ছিল বর্তমান প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে একে কাজে লাগানো। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল পরীক্ষাগার এলাকা হিসেবে গোটা একটি থানার অন্তর্ভুক্তি। এ পরীক্ষাগার এলাকার উদ্দেশ্য ছিল জরিপ-গবেষণা এবং কর্মোদ্যোগ-গবেষণা ও পাইলট প্রকল্পগুলো সংগঠন। তৃতীয় পদক্ষেপ ছিল পরীক্ষামূলক এলাকায় অনুপুঙ্খ সমীক্ষা পরিচালনা এবং গ্রামবাসীদের সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনা। চতুর্থ পদক্ষেপ ছিল জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। পঞ্চম পদক্ষেপ ছিল পাইলট প্রকল্পগুলোর অবিরাম মূল্যায়ন ও উপস্থাপনার মাধ্যমে শুধু প্রকল্পের অগ্রগতি নির্ধারণই নয়, বরং এদের দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ এবং প্রয়োজনানুসারে তা সংশোধন। ষষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল মডেলটিকে বহুমুখীকরণে সরকারি সংস্থাসমূহকে সহায়তা দান।
কুমিল্লা মডেলের বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি ও ধারণা কাজ করেছে সম্ভবত সেগুলো হচ্ছে: (১) গ্রামবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পল্লী উন্নয়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা, কেননা তারাই গ্রামীণ পরিস্থিতি ও গ্রামজীবনের সমস্যা সম্পর্কে সম্যক অবহিত; (২) উন্নয়নের উপকরণ যোগান দিলে গ্রামবাসীরা নিজেরাই তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে সক্ষম; (৩) গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকতর উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কৃষি উন্নয়নকে অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ; (৪) গ্রামকে উন্নয়নের মৌলিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা এবং আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া সূচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গ্রহণ; (৫) গ্রামোন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলো প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও নির্দেশনা এবং গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে এগুলোর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সৃষ্টি করা।
গ্রামোন্নয়নে কুমিল্লা উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল গ্রামীণ সমাজে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি রচনা এবং অতঃপর এর সঙ্গে কিছু বুনিয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার সামঞ্জস্য বিধান। এই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির প্রথম অবলম্বন ছিল একটি দু-ধাপবিশিষ্ট কৃষক সমবায়। প্রথম ধাপে গ্রাম পর্যায়ে ‘প্রাথমিক সমবায়’ (যেমন কৃষক সমবায় সমিতি) এবং দ্বিতীয় ধাপে থানা পর্যায়ে ‘প্রাথমিক সমবায়সমূহের কেন্দ্রীয় ফেডারেশন’ (যেমন থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি)। এগুলো ছিল কৃষকদের স্বেচ্ছাভিত্তিক অর্থনৈতিক সংগঠন। এসকল সমবায় সমিতির কার্যক্রম ছিল মিতব্যয়ী সঞ্চয়ের মাধ্যমে কৃষকদের পুঁজিগঠনে উৎসাহ দান, ঋণপ্রাপ্তিতে তাদের সাহায্য প্রদান, কৃষকদের মধ্যে উন্নত কৃষিপদ্ধতির প্রসার ঘটানো, কৃষকদের যৌথ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনসমূহ প্রয়োগে উৎসাহ দান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান। দ্বিতীয় অবলম্বন ছিল দ্বিবিধ উদ্দেশ্যসহ পল্লী কার্যক্রম কর্মসূচি, যেমন সংযোগকারী সড়কসমূহের অবকাঠামো তৈরি, নালা ও সেচব্যবস্থা এবং কাজের শ্রমঘন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল পল্লী কার্যক্রম কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। তৃতীয় অবলম্বন হিসেবে থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল থানা পর্যায়ের জাতিগঠনমূলক দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা ও থানার জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত গ্রামোন্নয়ন উদ্যোগের কাঠামোয় একত্রীকরণ। থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের অফিসের ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেণিকক্ষ ও কর্মশালা ইত্যাদির ব্যবস্থা এবং কেন্দ্রটিকে উন্নয়ন প্রশাসনের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। চতুর্থ অবলম্বন ছিল থানা সেচ-কর্মসূচি। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল কৃষকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেচ-প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ভিত্তিতে তাদের সেচসুবিধা প্রদান।
কুমিল্লা মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: (১) এ মডেলের চাবিকাঠি হিসেবে পল্লী উন্নয়নের পুরো প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, উন্নয়নের উৎকর্ষ সাধনের উপর গুরুত্বারোপ, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের শুদ্ধিকরণ এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের একটি সুষ্ঠু পদ্ধতি প্রয়োগের উপর গুরুত্ব আরোপ করা; (২) পল্লী উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে সংশ্লিষ্ট করা; (৩) প্রত্যেক গ্রামে নিজেদের সংগঠন ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের একটি ক্যাডার সৃষ্টি, যেমন ম্যানেজার, আদর্শ কৃষক, নারী সংগঠক, যুবনেতা, গ্রামের হিসাবরক্ষক; (৪) গ্রামাঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ উন্নয়নের জন্য তিনটি মৌলিক অবকাঠামো (প্রশাসনিক, ভৌত ও সাংগঠনিক) সৃষ্টি; (৫) বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তা ও জনসংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকৃত ও সমন্বিত পল্লী-প্রশাসনকে অগ্রাধিকার প্রদান; (৬) বিভিন্ন পরিপূরক গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রকল্প কার্যক্রম, পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উপখাতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন ও সমন্বিতকরণের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ উন্নয়ন; (৭) শিক্ষা, সংগঠন ও শৃঙ্খলা এ মডেলের প্রধান বৈশিষ্ট্য; (৮) একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণের জন্য অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ; (৯) কৃষকদের অবস্থার উন্নয়নের এবং গ্রামীণ শ্রমজীবীদের অধিকাংশের কর্মসংস্থানের উপযোগী একটি টেকসই ও প্রগতিশীল কৃষিব্যবস্থা উদ্ভাবন। এসব বৈশিষ্ঠ্যই সমাজ উন্নয়ন, টার্গেট গ্রুপ উদ্যোগ, নিবিড় এলাকা উন্নয়ন প্রভৃতি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টার মধ্যে কুমিল্লা মডেলকে একটি ব্যক্তিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। [সালেহ উদ্দীন আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি MA Quddus (ed.), Rural Development in Bangladesh, Comilla, 1993; AH Khan, Works of Akhter Hameed Khan, Vol. III, Comilla, 1984; AH Khan, Director's Speech in First Annual Report, Comilla, 1960.