কাসেম, আবুল
কাসেম, আবুল (১৮৭২-১৯৩৬) রাজনীতিবিদ। জন্ম ১৮৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার কাশিয়ারা গ্রামে। তাঁর পিতা আবদুল মজিদ আবগারি শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন এবং পিতামহ খান বাহাদুর গোলাম আসগর ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের বিচার বিভাগের প্রধান সদর আমিন।
আবুল কাসেম কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বি.এ. পাস করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ বার্ষিক অধিবেশনে তিনি উত্তর কলকাতার প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
১৮৯৭ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত আবুল কাসেম তাঁর চাচা ভুপালের মুখ্যমন্ত্রী নওয়াব আবদুল জববারের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৪ সালে তিনিভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটি এবং সাংবিধানিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সকল অধিবেশনে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১) একজন প্রভাবশালী জাতীয় নেতা ছিলেন।
মুসলিম লীগ গঠনের সমান্তরালে কলকাতায় ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করা হয়। এর সভাপতি ছিলেন মাদ্রাজের সৈয়দ মোহাম্মদ বাহাদুর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও ব্যারিস্টার আবদুর রসুল ছিলেন যথাক্রমে এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি। বাংলা থেকে এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন আবুল কাসেম। একই বছর বাংলার মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতাদের উদ্যোগে বেঙ্গল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন নামে অপর একটি সংগঠন গড়ে ওঠে এবং আবুল কাসেম হন এর প্রথম সেক্রেটারি। এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল। এ সময়েই তিনি বর্ধমান মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন।
আবুল কাসেম জীবনের প্রথমদিকে স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর দ্য বেঙ্গলি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দ্য মোসলমান প্রকাশ করেন এবং তিনি এর প্রথম সম্পাদক হন। এ ছাড়া তিনি কয়েকটি অল্পায়ু পত্রিকা- যেমন, মুসলিম ক্রনিকল, মুসলিম আউটলুক-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা নবযুগ প্রকাশে এ.কে ফজলুল হককে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া তিনি অন্য সংবাদপত্র যেমন- প্রোগ্রেস, মুসলিম স্টান্ডার্ড এবং মোসলেম বাণী নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন।
আবুল কাসেম বর্ধমান-বাঁকুড়া বিধান সভা থেকে ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড এবং পরবর্তী রাউলাট বিলের (১৯১৯) বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ দুয়ের প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গীয় আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন।
আবুল কাসেম ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলনএ যোগ দেন। তিনি খিলাফত কমিটির সদস্য হন এবং উক্ত আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯২০ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে খিলাফতের যে প্রতিনিধি দল ইউরোপে পাঠানো হয়, তিনি ছিলেন এর একজন সদস্য। খিলাফত আন্দোলন শেষে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট আইন (১৯১৯) অনুসারে প্রথম যে ভারতীয় আইন পরিষদ (১৯২১-১৯২৩) গঠিত হয় তিনি তার সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের (১৯২৪-২৬) মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন। তিনি নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ১৯২৭ সালে পুনরায় আইন পরিষদে প্রবেশ করেন এবং আমৃত্যু এর সদস্য পদে বহাল ছিলেন।
প্রায় প্রতি বছর দামোদর, অজয় এবং কুনুর নদীর প্রভাবে বর্ধমান, বীরভুম এবং বাঁকুড়া জেলায় বন্যা দেখা দিত। আবুল কাসেম উক্ত এলাকায় বন্যার ত্রাণের কাজ সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাস্তা নির্মাণ, বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রচেষ্টায় সহায়তা করেন। তাঁর উদ্যোগে বর্ধমান টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ছিলেন ১৯৪০ এর দশকে বেঙ্গল মুসলিম লীগের অন্যতম সংগঠক ও নেতা আবুল হাশিম। ১৯৩৬ সালের ১০ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। [বদরুদ্দিন উমর]