কালীঘাট চিত্রকলা
কালীঘাট চিত্রকলা উনিশ শতকে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতার কালীঘাটের কালীমন্দিরের সন্নিহিত বাজার এলাকায় বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত রীতি এমন ছিল যে, তীর্থযাত্রীরা তাদের নিজেদের এবং তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য তীর্থযাত্রার স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্নসমূহ নিয়ে যেতেন। স্থানভেদে এসব সামগ্রীর ধরন ও প্রকৃতি ভিন্ন ছিল। কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে স্মারক হিসেবেই কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এ চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক-ধর্মীয় কাহিনী। কিন্তু ক্রমে তা ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে এবং এতে সমসাময়িক সামাজিক বিষয়ের প্রতিফলনও লক্ষ্য করা যায় যা এতদিন পর্যন্ত তীর্থক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট শিল্পকলার আওতা বহির্ভূত ছিল। এ চিত্রকলায় নবজাত নাগরিক সমাজের মূল্যবোধ প্রতিফলিত ও উপস্থাপিত হয়েছিল। শিল্পীরা মুসলিম ক্রেতাদের জন্য দুলদুল ও অন্যান্য বিষয়ও অঙ্কন করতেন। এ চিত্রকলায় বিচিত্র উপাদানের সংমিশ্রণের ক্ষমতা এবং এর পরিবর্তন সাধন করে এক নতুন ও প্রাণবন্ত দৃষ্টিগোচর ছবি চিত্রায়িত করার দক্ষতা প্রকাশ পায়।
বর্তমান কালীমন্দির স্থাপিত হয়েছিলো উনিশ শতকের প্রথম দিকে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে একটা বাজারও গড়ে উঠেছিল। ক্রমে বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে ঐতিহ্যবাহী পটুয়ারা কালীঘাটে এসে বসতি স্থাপন করেন। যে এলাকায় এসে তাঁরা বসবাস শুরু করেন, সে এলাকা তাঁদের পেশা অনুযায়ী পরিচিতি লাভ করে, যেমন, পটপাড়া বা শিল্পীদের এলাকা। প্রথম দিকে শিল্পীরা তাদের খন্ডকালীন কাজ হিসেবে কাগজের ওপর হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি অাঁকতে শুরু করেন। মিসেস বেলনস নাম্নী একজন ইউরোপীয় চিত্রকর তাঁর ম্যানার্স ইন বেঙ্গল (১৮৩২) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, তিনি দেশীয় দেবতাদের ছবিসহ ‘কয়েকটি অপটু চিত্রকর্ম’ দেখেছেন। এ চিত্রগুলি দরিদ্র লোকদের ঘরে শোভা পাচ্ছিল যারা অতি কষ্টে দিনযাপন করত। তাঁর অাঁকা একটি স্কেচে বাঙালি গৃহে কালীঘাট চিত্রকলা দেখা যায়।
গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত এ চিত্রকরবৃন্দ নাগরিক সংস্কৃতি ও আচার-আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং আবেগ দিয়ে তারা তাদের সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ লিপিবদ্ধ করতেন। এভাবে এক ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ চিত্রকলার সূচনা ঘটে যা বাবু সংস্কৃতি, নারীবাদ, সামাজিক লাম্পট্য, ধর্মীয় ভন্ডামি ও সবরকমের মিথ্যাচারকে অবজ্ঞা করেছিল।
তাই শিল্পী হয়ে ওঠেন একজন সমাজ সমালোচক। এক টাকায় ১৬ থেকে ৬৪টি চিত্রকর্ম পাওয়া যেত এবং এ ধরনের কাজ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে একটা তৈরী বাজার পেয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন ভারতীয় পন্ডিতগণ তাদের ভিক্টোরীয় আদর্শের পরিপন্থি সবকিছুকেই ঘৃণা করতেন। রুডিয়ার্ড কিপলিঙ এ শিল্পকলার সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হন এবং অনেকগুলি চিত্রকর্ম সংগ্রহ করে তিনি ১৯১৭ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া ও অ্যালবার্ট মিউজিয়মে দান করেন। এখানে এবং প্রাগ মিউজিয়মে কালীঘাট চিত্রকলার সর্বোত্তম সংগ্রহ রয়েছে।
চিত্রকলার বিষয়ের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছিল চিত্রকরদের গোঁড়া অনুভূতি। তাঁরা মনে করতেন যে, সামাজিক পরিবর্তন ঘোর বিশৃঙ্খলা বয়ে আনবে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রূপক বর্ণনা হিসেবে বাঘের সাথে শ্যামকান্তের যুদ্ধ এবং ঝাঁসির রাণির অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ ছাড়াও চিত্রকলার জনপ্রিয় বিষয়গুলির মধ্যে ছিল স্বামী কর্তৃক অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে লvাঞ্ছত করা, স্বামীর কাঁধে আদুরে বৌ এর আরোহণ, বাবুদের সঙ্গে রক্ষিতা, কেতাদুরস্ত বাবু, পরোক্ষভাবে লাম্পট্যের উল্লেখ স্বরূপ হিন্দুধর্মের পবিত্র চিহ্নসহ বিড়াল। শিল্পীরা লোকাচার বিদ্যা থেকে ধর্মীয় বিষয়গুলি গ্রহণ করতেন এবং মানুষ ও দেবদেবীর গায়ে একই গহনা শোভা পেত। নলাকার শারীরিক গঠন, দেহরেখার সর্বত্র অযৌক্তিক ছায়াসৃজন, অতি সরলীকৃত আকার ও তার পুনর্বিন্যাস, কোনোরকমের আনুষঙ্গিক অলংকার বা অবলম্বন ছাড়া ছবির সবটা অংশ জুড়ে মূর্তিসমূহের প্রাধান্য প্রভৃতি আধুনিক চিত্রকলায় বেশ কিছু নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল।
উইলিয়ম আর্চার তাঁর কালীঘাট পেইন্টিং গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, বিশ শতকের প্রথম দিকে প্যারিস-ভিত্তিক আধুনিক শিল্পীরা কালীঘাট চিত্রকলা শেখার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। কালীঘাটের গোলাপ সুন্দরী-র বিপরীতে যে কেউই এলোমেলোভাবে পাবলো পিকাসো, ফার্নান্দ লেগার ও অঁরি মাতিসের কথা মনে করতে পারেন। কালীঘাট চিত্রকলার উদ্দেশ্য ছিল একটা প্রাণবন্ত ধারা সৃষ্টি করা যা বিষয়কে সাদামাটাভাবে প্রকাশ করার চেয়ে সহজজ্ঞানে তা অনুধাবনে সহায়তা করে। স্তরসমূহের বিন্যাসে ছবির আয়তনের দ্বি-মাত্রিক গুণ প্রকাশ পায়। বলিষ্ঠ রেখা, প্রশস্ত স্তরসমূহ, চমৎকার বর্ণাধার, রৈখিক প্রসারণ এবং ছন্দিত বাঁক-সব মিলে এক দৃষ্টিনন্দন সঙ্গীত তৈরি হয়। চিত্রকরগণ তাদের শিল্পকর্মসমূহ স্বাক্ষরবিহীন অবস্থায় রেখে গেছেন এবং সেগুলি এখন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
কালীঘাট চিত্রকলায় চৌকোশ পট বা উল্লম্ব আয়তক্ষেত্রিক আকার দেখা যায়। সাধারণভাবে এর আকার ছিল ১১র্ × ১৭র্ বা ২৭ × ৪৩ সেমি। চিত্রকলায় সস্তামানের কাগজ এবং সস্তায় তৈরী রং ব্যবহূত হতো। কাঠবিড়ালি ও বাছুরের পশম দিয়ে তৈরি হতো ব্রাশ। প্রথাগত ভারতীয় রঙিন প্রলেপ বা অসচ্ছ রঙের বিপরীতে স্বচ্ছ আভা সৃষ্টির জন্য রং ব্যবহার করা হতো। চার ধরনের ব্রাশের কাজ হতো। প্রথমত, পানিসহ মোটা ব্রাশের অগ্রভাগ কালো কালি বা রঙের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া হতো যাতে কেবল একটি টানে ছায়াময় দেহরেখা, এর নমনীয়তা এবং নলাকার পিন্ড সৃষ্টি করা যায়। দ্বিতীয়ত, কালো বা গাঢ় রঙের চটুল, সরু ও ছোট টান ব্যবহার করা হতো যাতে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, চোখ, নাক, আঙুল বা পোশাকের ভাঁজ বা অংশ আলাদা করে নির্দেশ করা যায়। তৃতীয়ত, কাপড়ের পাড় চিহ্নিত করার জন্য মোটা কালো রেখা ব্যবহার করা হতো। কালো ঘেরের সাহায্যে চুলও অাঁকা হতো। চতুর্থত, কাপড়ের বর্ণ এবং শরীর থেকে তা পার্থক্য করার জন্য রঙের ছোপ ব্যবহার করা হতো। কখনও কখনও শরীরের অঙ্গেও বাড়তি রং ব্যবহার করা হতো। ছায়াময় দেহরেখা ও সুস্পষ্ট অঙ্গভঙ্গি এবং গতির সাহায্যে দেহাবয়ব অরঞ্জিত জমিনের ওপর এক পটোপম বৈশিষ্ট্য পেত।
আঙ্গিকগত ও রৈখিক পরিমিতি, অভিব্যক্তিময় ভঙ্গিমা, তুলির নৈপুণ্য এবং নির্ভুল ছন্দময় টানের মাধ্যমে এ রীতি প্রতীকায়িত হয়ে ওঠেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে অলংঙ্কারাদির জন্য রূপা ব্যবহার করা হতো।
ঔপনিবেশিক আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষাকৃত অধিক দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রকৃতিবাদী তৈলকর্মের কাজের মাধ্যমে এতদঞ্চলে রুচির পরিবর্তন সাধিত হয়। আর জার্মানি থেকে আমদানি করা প্রিন্টগুলি বিশ শতকের প্রথম ভাগে বাজার থেকে কালীঘাট চিত্রকরদের অবশেষে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করে। ভারতীয় উপমহাদেশে কালীঘাট চিত্রকলাই ছিল নিম্নশ্রেণীর সংস্কৃতির প্রথম শৈল্পিক প্রকাশ এবং এ চিত্রকলার গন্তব্য ছিল সরাসরি ক্রেতার কাছে। এগুলি পুঁজিপতি বা ক্ষমতাসীন শাসকদের নির্দেশে কিংবা তাদের জন্য তৈরি করা হয় নি। [শোভন সোম]