কামরূপ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:৩২, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

কামরূপ এবং প্রাগজ্যোতিষকে প্রায়শ অভিন্ন এবং উপমহাদেশের পূর্বাংশের একই অঞ্চল হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।  মহাভারত এ প্রাগজ্যোতিষের উল্লেখ আছে কিন্তু কামরূপের উল্লেখ নেই। কালিদাসএর রঘুবংশ একই সঙ্গে প্রাগজ্যোতিষ ও কামরূপ উভয়ের উল্লেখ করেছে। সমুদ্র গুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে (চার শতকের মাঝামাঝি) কিছু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত দেশের সঙ্গে কামরূপের নাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া চীনা তীর্থ যাত্রী হিউয়েন সাংও পুন্ড্রবর্ধন থেকে ভাস্কর বর্মণের দেশে তাঁর ভ্রমণের সময় কামো-রূ-পো (কামরূপ) এবং কালো-তু(করতোয়া) উল্লেণখ করেছেন। অন্য দিকে দুবি  তাম্রশাসন, ভাস্কর বর্মণের নালন্দা ক্লে-সিলসমূহে (কাদামাটির সিল বা মোহর), এমনকি নারায়ণ পালের ভাগলপুর দানপত্রে আমরা প্রাগজ্যোতিষ নামটির উল্লেখ পাই।

সুতরাং যুক্তিসঙ্গতভাবে উপসংহার টানা যায় যে, কামরূপ নামের পূর্ব থেকেই গ্রাগজ্যোতিষ নামটি প্রচলিত ছিল। পন্ডিতদের কেউ কেউ রাজ্য দুটিকে পৃথক রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করলেও এখন এটি স্বীকৃত যে উভয় নামই একই ভূখন্ডের। সম্ভবত প্রাচীন কালে  গ্রাগজ্যোতিষ একটি বিস্তীর্ণ ‘জনপদ’ ছিল যেখান থেকে পরবর্তী সময়ে কামরূপ একটি ছোট রাজ্য হিসেবে বেরিয়ে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ বারো শতকের প্রায় মধ্যভাগে বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে প্রাগজ্যোতিষকে একটি ‘ভুক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে কামরূপ ছিল একটি ‘মন্ডল’।

পুরাণ এবং  তন্ত্র সাহিত্যে এ কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপের সীমানা সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। ‘কালিকাপুরাণে’ এটির অবস্থান করতোয়া নদীর পূর্বে ত্রিভুজাকৃতি বলা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১০০ যোজন ও প্রস্থ ৩০ যোজন এবং এটি পূর্বদিকে দিক্কারবাসিনী (আধুনিক দিকরাই নদী) পরিবেষ্টিত ছিল। অন্যদিকে ‘যোগিনী তন্ত্র’ পুরো কামরূপকে ‘রত্নপীঠ’, ‘ভদ্রপীঠ’, ‘সৌমর পীঠ’ এবং ‘কামপীঠ’ রূপে বিভক্ত করেছে এবং এর সীমানা উত্তর দিকে কাঞ্জ পাহাড়, পূর্ব দিকে পবিত্র নদী দীক্ষু (সাদিয়ায় আধুনিক দিবাং), পশ্চিমে করতোয়া এবং দক্ষিণ দিকে লক্ষ (আধুনিক লখ্যা) ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহকে নির্দেশ করেছে। এটা সত্য যে, প্রতিবেশী শক্তিসমূহের সংঘাতের ফলে করতোয়া নদীর সন্নিহিত পশ্চিম সীমানার পরিবর্তন ঘটেছে।

মনে হয়, এক সময় কামরূপ রাজ্যে বর্তমান ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, ভুটান, রংপুর, ‘কুচবিহার’ এবং বেশ কিছু সন্নিহিত অঞ্চল অন্তর্ভূুক্ত ছিল। সীমানার এ পরিবর্তনের সঙ্গে মহাভারতে (স্ত্রীপর্ব) বর্ণিত ঘটনার সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত তার সৈন্যদল নিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। সৈন্যদলটি মঙ্গোলীয় (‘কিরাত, চীনা’ এবং ‘পূর্বসাগরবাসী’) বা ইন্দো-মঙ্গোলীয় (বোড়ো, তিববতীয়, ভুটানি ইত্যাদি) মানবগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত ছিল। এরা বর্তমানকালেও এ’অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি প্রধান অংশ হিসেবে রয়েছে।

তেরো শতকে অহোমদের আগমনের সময় পর্যন্ত, যখন এটি অসম (অতুলনীয়) বা আসাম নাম গ্রহণ করে, কামরূপ প্রাচীনতম রাজা মহিরঙ্গ দানব থেকে শুরু করে কমপক্ষে চারটি রাজবংশ দ্বারা শাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। রাজবংশগুলি ছিল- নারক > ভাউমা > শালাস্তম্ভ > পাল। অনার্য ও আর্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফলে এটি একটি বিখ্যাত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেও পরিণত হয়।

‘কামরূপ’ শব্দটি একটি অস্ট্রিক শব্দ গঠন ‘কামরূ’ বা ‘কামরূত’ থেকে এসেছে যা সাঁওতালি ভাষায় একটি তাৎপর্যহীন দেবতার নাম যা দ্বারা যাদুবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বোঝায়। বিকে কাকাতীর মতানুসারে, এ শব্দ নতুন ধর্মীয় প্রথা মাতৃদেবী কামাখ্যার উপাসনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তিনি আরও মনে করেন যে, কামাখ্যা শব্দটি অস্ট্রিক শব্দ গঠন পুরানো খেমার শব্দ ‘কামোই’ (দৈত্য), চাম শব্দ ‘কামত’ (প্রেত), খাসী শব্দ ‘কামেৎ’ (মরদেহ), সাঁওতালি ভাষার কামিন (সমাধি) অথবা কোমৌচ (মরদেহ) থেকে এসেছে। আরেকটি ব্যাখ্যানুযায়ী কামক্ষ বা কামল্খীর সংস্কৃতায়িত গঠন হলো কামাখ্যা। এটি প্রাচীন আসামের মঙ্গোলীয় উপজাতির একটি দেবী। কামরূপ শব্দের উৎস সম্পর্কে অবশ্য একটি লোকপ্রিয় উপাখ্যানের সূত্র নির্দেশ করা হয়। সূত্রটি গোপথ ব্রাহ্মণে বর্ণিত দেবতা শিবের অগ্নি দৃষ্টিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত কামদেবের কামরূপে পুনর্জন্মের গল্প নির্দেশ করে। কালিকাপুরাণ অনুসারেও কামাখ্যা শব্দের উৎপত্তি কামরূপ সীমানার মধ্যে সতীর জননেন্দ্রিয় পতিত হওয়ার সঙ্গে জড়িত।

প্রাচীন ও মধ্যযুগে কামরূপ  কামরূপের প্রাচীন ভূমিতে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর বসতি শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মেরও দু শত বছর পূর্ব থেকে। অষ্ট্রিক জাতির বংশধর কার্বিসরাই সম্ভবত আসামের আদি অভিবাসী। এ জাতি থেকেই খাসিয়া, জৈন্তিয়া, কুকি, লুসাই (মিজো) উপজাতির উদ্ভব। কিরাতরা চীনের পশ্চিম অংশ থেকে এসে বসতি গড়ে। এরা ছিল মঙ্গোলীয় জাতিভুক্ত এবং এদের ভাষা ছিল চীনা-তিববতীয়। বোড়ো, গারো, রাভা, দেউরি, মিসিং, মোরান, সুতিয়া, দিমাসা এবং কোচ (রাজবংশী), লালুং, হাজংরাও এ একই জাতির অন্তর্ভুক্ত। একই এলাকায় উভয় জাতির সহাবস্থানের কারণে এদের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটে এবং এ সংমিশ্রণের পটভূমিতেই শুরু হয় অহোমীয় জাতি বিনির্মাণের প্রক্রিয়া। এর পরই বাংলা থেকে দ্রাবিড় জাতির উত্তরসূরি কৈবর্ত্য ও বানিয়ারা সেখানে অভিবাসিত হয় এবং কম বেশি পারস্পরিক সংমিশ্রণ ঘটায়।

ঐতিহাসিক যুগে একদিকে রাজা ও রাজবংশের উদ্ভব ঘটে, এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ যাজকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে একটি যাজক শ্রেণির সৃষ্টি হয়, এবং অন্যদিকে কৃষি-দাস ও রাজ পরিবারের নিম্নশ্রেণীর লোকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কৃষকশ্রেণি। কামরূপ সমাজে এ ধরনের, শ্রেণিবিন্যাসকালে বর্মন রাজবংশের প্রথম রাজা ৩৫০ থেকে ৩৮০ সাল পর্যন্ত প্রাগজ্যোতিষপুরে রাজত্ব করেন। এ সময়েই প্রাগজ্যোতিষপুরের নতুন নামকরণ হয় কামরূপ।

অহোমীয় শাসনামলে শিখ ধর্মশুরু তেগবাহাদুর এবং ইসলাম ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ আজান ফকির কামরূপে আসেন, এবং এ শাসনামলেই হিন্দু ধর্মাচার্য শ্রীমন্ত শঙ্করদেব কামরূপে জন্মগ্রহণ করেন। এ ধর্মগুরুরা ধর্মপ্রচার শুরু করলে জনগণের মধ্যে রাজকীয় ভাষা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। অনুরূপভাবে ইতিহাসচর্চা (বুরুঞ্জি) এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এ সময়ে কামরূপের ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়।

মহারাজ প্রতাপচন্দ্র সিংহের শাসনামল পর্যন্ত রাজকীয় প্রশাসনে গোত্রীয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে ভূমির জরীপ ব্যবস্থা, আদমশুমারীর প্রচলন ও পাইক প্রথার প্রবর্তন, উন্নততর সামন্ত প্রথার প্রচলন এবং পরিশেষে ভারত থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের আগমন ও পুনর্বাসনের কারণে গোত্রীয় জনকাঠামো ভেঙে পড়ে এবং প্রচলিত গোত্রীয় প্রথা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে।

মধ্যযুগে বাংলার সুলতান ও মুগল সুবাহদারগণ বহুবার আসাম ও কামরূপ দখলের প্রয়াস চালান। এ ব্যাপারে ইলিয়াস শাহহোসেন শাহমীরজুমলা এর প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু এসকল প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত বিজয় থেকে কোনো স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপিত হয় নি।

আধুনিক কামরূপ  শাসকশ্রেণীর সঙ্গে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার আকারে সাধারণ কৃষকশ্রেণীর বিরোধের প্রতিফলন ঘটে মোয়ামারিয়া বিদ্রোহের (১৭৬৯-১৮২৬) মাধ্যমে এবং দিনে দিনে তা তীব্রতর হতে থাকে। শাসকগোষ্ঠী ও প্রজাদের মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে কামরূপে অহমীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সামাজিক জীবনও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সারা দেশে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে; গণবিদ্রোহের ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এতে করে আসামের সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একদিকে সর্বনানন্দ সিংহের আহবানে সাড়া দিয়ে বর্মীরা এবং অন্যদিকে গৌরীনাথ সিংহের আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা কামরূপ দখলের উদ্দেশ্যে অভিযান চালায়। দু বিদেশি শক্তির একের পর এক আক্রমণে অসংখ্য প্রাণহানি ও প্রচুর সম্পদ বিনষ্ট হয়। ১৮১৭, ১৮১৯ ও ১৮২১ সালে আসাম দখলের পর বর্মীরা ১৮২২ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত আসাম শাসন করে।

ব্রিটিশ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ওয়েলেসের বিশেষ দূত গিগার এনসাইসউড ও ড. জন পিটার বাউডি আসামের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য ১৭৯৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অহোম রাজা গৌরিনাথ সিংহের সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করেন। ব্রিটিশ প্রতিনিধির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে।

ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড  আমহার্স্ট বর্মী দখলদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযানের ঘোষণা দেন। বর্মীরা আসাম দখলে রেখে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলও অধিকারের চেষ্টা চালায়। এ পাল্টা আক্রমণ পরিচালনার অংশ হিসেবে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের ব্রিটিশ এজেন্ট ডেভিট স্কট আসামের কাছাড় এলাকায় পৌছেন। তিনি সেখানে একটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে আসাম থেকে বর্মীদের বিতাড়ন এবং আসামে সকল শ্রেণির জনগণের সুখসাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

১৮২৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আসামে বর্মীদের পরাজিত ও বিতাড়িত করার পর ব্রিটিশ সরকার বর্মী জেনারেলের সঙ্গে ইয়াদাঁবু চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তারপর আসামে সব ধরনের সুখ স্বাচ্ছন্দ সমৃদ্ধি এবং শান্তি ‘সর্বোপরি জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি সরকার গঠনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটিশরা কামরূপসহ আসাম দখল করে। ডেভিড স্কটের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে অস্বীকার করায় অহোম জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং ইয়াদাঁবু চুক্তি স্বাক্ষরের পর দু বছর যেতে না যেতেই ধনঞ্জয় গোহাইন, পিওলি ফুকান, গোমধর কোয়ারের নেতৃত্বে অহোমদের মধ্যে স্বাধীনতার দাবিতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮২৬ সালের এপ্রিল মাসে এবং দ্বিতীয় বার ১৮৩০ সালের ২৫ মার্চ।

ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৮২৬ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত আসামকে সামরিক শাসনের অধীনে রাখে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আসামের বাণিজ্যিক গুরুত্ব নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানো। ১৮৩৮ সালে অহোম রাজা পুরন্দর সিংহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ওই বছর থেকেই সমগ্র আসামকে ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত করা হয়। ১৮৩৮ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলার সদরদপ্তর থেকে ব্রিটিশরা আসাম শাসন করত। ১৮৭৪ সালে আসামকে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে গঠিত নতুন প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বহাল ছিল।

চায়ের আবাদ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে বঞ্চিত করার কৌশল হিসেবে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ওয়েইস্ট ল্যান্ড রেগুলেশন আরোপ করে। এ রেগুলেশনের আওতায় আসামের স্থানীয় জনগণের তুলনায় ব্রিটিশ নাগরিকদের ভূমি-রাজস্ব ছিল অনেক কম। অন্যদিকে এ রেগুলেশন দ্বারা স্বল্প মূলধনের শিল্পপতিদের ভূমি অধিকার লাভে বঞ্চিত করা হয়, কারণ এর দ্বারা যেকোনো ব্যক্তিকে ১০০ একরের কম জমি ইজারা গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

এ অদ্ভূত রেগুলেশনের মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসন সমগ্র চা শিল্পকে ব্রিটিশ আবাদকারীদের হাতে ন্যস্ত করে একটি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি গঠনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। বিভিন্ন বাণিজ্যিক অজুহাতে তারা অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা থেকে শ্রমিক আমদানি করতে থাকে এবং এতে করে স্থানীয় শ্রমিকদের জীবিকার্জনের পথ রুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ পুঁজি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের অভিবাসন আসামের জনসংখ্যা কাঠামোতে পরিবর্তনের সূচনা করে। অভিবাসিত এসব শ্রমিক এবং ভারতীয় অন্যান্য চাকুরেদের প্রয়োজনে বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। চা আবাদকারী মালিকদের সমর্থনে মাড়োয়ারি ও বাঙালি ব্যবসায়ীরা এখানে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ পায়। কেরানি, লিপিকার ও সুপারভাইজারের শূণ্য পদগুলি পূরণ করা হয় বহিরাগত বাঙালিদের দ্বারা। এতে স্থানীয় জনগণ এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে চা শিল্পের উদ্বৃত্ত মূলধন এবং চাকুরিজীবীদের বেতনের অর্থ অব্যাহতভাবে দেশের বাইরে পাচার হতে থাকে। উপনিবেশিক এ শোষণ স্থানীয় পুঁজির অবাধ বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং দ্রুত বহিরাগত শিল্পপতি বিকাশকে উৎসাহিত করে।

ব্রিটিশ শোষণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এ অসন্তোষ চূড়ান্ত বিদ্রোহের রূপ নেয়। বিক্ষুব্ধ অহোম জনগণ ‘রাইজমেল’ (গণপরিষদ) এর নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় জীবন মরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। প্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয় ফুলগুড়িতে ১৮৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং পরে পাতিদারাং, নলবাড়ি, লাচিমা, বারামা, বাজলি, খেত্রি, উপর বারভাগ, রঙ্গিয়া এবং সর্বশেষ ১৮৯৪ সালে বিখ্যাত পাথারুঘাটে নিজেদের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জনগণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এসব বীরোচিত সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও রাইজমেলের নেতৃত্বে পরিচালিত জাতি গোত্র ও বর্ণ নির্বিশেষে আপামর জনগণের এ সংগ্রাম ছিল অহোমীয় জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত এবং কামরূপ ছিল এর প্রাণকেন্দ্র।

১৯৩৫ সালে প্রথমবারের মতো আসামে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করা হয়। নির্বাচনের রাজনীতির ফলে সৃষ্টি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে উপজাতি ও অ-উপজাতি, হিন্দু ও মুসলিম নানামুখী স্রোতধারায়।

ব্রিটিশ শাসনামলেই বিশ শতকের প্রথম দশকে ৪৩৯ মাইল দীর্ঘ রেলসড়ক নির্মিত হয়েছিল এবং ব্রিটিশরাই প্রথম ডিগবয়ে এশিয়ান অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ শাসনামলে জলপথের পাশাপাশি সড়কপথে যোগাযোগও প্রশস্ত হয়েছে। চা, কয়লা, প্লাইউডের মতো কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়। কিন্তু এসব উন্নয়ন থেকে স্থানীয় জনগণ তেমন কোনো সুবিধাই পায়নি। এসব থেকে মূলত ব্রিটিশ ও স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসকগোষ্ঠীই লাভবান হয়েছে।

পুরানো পাইক ও খেল পদ্ধতির বিলোপ সাধন করে ‘ভূমি ও রাজস্ব’ পদ্ধতি চালু করা হয়। এভাবেই তারা সামন্ত প্রথার অন্তরালে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা করে। প্রজাদের আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে তারা পুরনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশকে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত করে উপনিবেশিক প্রশাসনে নিয়োগ করে। এসব শিক্ষিত লোকদের শহর এলাকায় ম্যাজিষ্ট্রেট, মুন্সেফ, দারোগা ও কেরানি পদে এবং পল্লী এলাকায় মৌজাদার, চৌধুরী, গ্রামপ্রধান ও মড়ঁল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা ব্রিটিশের আস্থাভাজন গোষ্ঠীতে পরিণত হয় এবং এরাই অহমীয় সমাজের নতুন ভিত্তি গড়ে তোলে। এভাবেই পুরনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন অহোমীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে।  [ইছামুদ্দীন সরকার]