কাটরা
কাটরা কাটরা সম্ভবত আরবি ‘কাতার’ বা ‘কাতারা’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ খিলানযুক্ত ভবন। আরবি ও ফারসি সাহিত্যে এর উল্লেখ ‘ক্যারাভান সরাই’ বা ‘সরাইখানা’ হিসেবে পাওয়া যায়। তাই বলা যায় যে, কাটরা হলো পথচারী, বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত সরাইখানা। এ সরাইখানা সাধারণত একটি অঙ্গনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। অঙ্গনের চারদিকে নির্মিত হয় বারান্দা এবং এর পরেই কক্ষসমূহ। কক্ষসমূহে পথচারী এবং ব্যবসায়ীরা রাত যাপন করেন, আর তাদের যানবাহনের পশু-যেমন, ঘোড়া, উট ইত্যাদি ও শকট এবং ভ্রমণের অন্যান্য সরঞ্জামাদি রাখা হতো অঙ্গনে। জানা যায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের ফলে সবদেশেই বাণিজ্যপথের পাশেই কয়েক মাইল পরপর কাটরা বা সরাইখানা নির্মিত হতো।
বাণিজ্যের সুবিধার্থে বাংলাদেশেও কাটরা নির্মিত হতো। এর উদাহরণ পাওয়া যায়। ঢাকায় মুগলদের সময়ে নির্মিত দুটি কাটরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাটরা দুটি হলো- বড় কাটরা ও ছোট কাটরা। মুগল যুগের স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এ দু’টি কাটরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বড় কাটরা মুগল রাজধানী ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। মুগল সুবাহদার শাহশুজার মীর-ই-ইমারত (প্রধান স্থপতি) দীউয়ান মীর মুহম্মদ আবুল কাসেম ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে এ ভবন নির্মাণ করেন। বড় কাটরায় ফারসি ভাষায় লিখিত দুটি শিলালিপি আছে। এর একটিতে উৎকীর্ণ আছে যে, এ ভবন আবুল কাসেম কর্তৃক ১০৫৩ হিজরিতে (১৬৪৪ খ্রি.) নির্মিত হয়েছে। অন্যটিতে দেখা যায় যে, ১০৫৫ হিজরিতে (১৬৪৬ খ্রি.) শাহ সুজা স্থাপত্যটি কাটরা হিসেবে ব্যবহারের জন্য মীর আবুল কাসেমকে দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, এ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণ কাটরায় অবস্থান করার প্রকৃতযোগ্য কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে কোনো ভাড়া গ্রহণ করবেন না। কাটরার ব্যয় নির্বাহের জন্য ২২ টি দোকান ওয়ক্ফ করে দেওয়া হয়।
বড় কাটরা চতুর্ভুজাকৃতির একটি অঙ্গনকে বেষ্টন করে নির্মিত হয়েছিল। এর প্রতি পার্শ্বে ২২টি কক্ষ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুট অত্যুচ্চ প্রবেশপথ ছিল। বড় কাটরার সম্মুখভাগ ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে। এ কারণে এর দক্ষিণাংশ জমকালো করে পরিকল্পনা এবং মুগল রীতিতে শিল্পবিন্যাস করা হয়েছিল।
বর্তমানে বড় কাটরা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর উত্তরাংশ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমাংশের সামান্য কিছু এখনও আছে। কিন্তু দক্ষিণাংশের কাঠামো এখনও পুরোপুরিভাবে বর্তমান। দক্ষিণাংশের দৈর্ঘ ৬৭.৯৭ মি। এ অংশের মাঝখানে রয়েছে অত্যুচ্চ ও সুগঠিত ত্রিতল প্রবেশপথ। এ প্রবেশপথ ছিল অতি মনোমুগ্ধকর এবং এটি দক্ষিণে নদীর দিকে প্রায় ৭.৬২ মি. ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২.১৯ মি. প্রসারিত ছিল। এ প্রবেশপথের দুপাশে ছিল দুটি প্রহরীকক্ষ। প্রহরীকক্ষ দুটির আয়তন ছিল পূর্ব-পশ্চিমে ৫.৫ মি/২.৯ মি.। এ প্রবেশপথের পরে ছিল পরপর তিনটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আয়তনের প্রবেশপথ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এগুলির আয়তন ছিল যথাক্রমে ২.৭/.৯১ মি, ৩.৩৫/.৯১ মি ও ২.৭/১.৮ মি।
উপরে উল্লিখিত চারটি প্রবেশপথের পরেই ছিল অষ্টকোণাকৃতির একটি হল কামরা। এর উপরের ছাদ ছিল গম্বুজকৃতির এবং তাতে পলেস্তরার উপর নানা রকম লতাপাতা ইত্যাদির সুন্দর অলঙ্করণ ছিল। এ হল কামরার মাঝামাঝি অংশের সোজা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল পর পর দুটি করে কামরা। কাটরার ভেতর দিকে দোতলা ও তিনতলায় উঠার সিঁড়ি আছে। উপরে দোতলায় এবং তিনতলায় নির্মিত ছিল বসবাসের কক্ষ। শুধু প্রবেশপথের উপরের অংশই ছিল তিনতলা বিশিষ্ট। তিনতলার কক্ষসমূহ চতুষ্কোণাকার এবং অশ্বক্ষুরাকৃতি ফ্ল্যাট আর্চ সম্বলিত ছিল। কাটরার বাকি অংশ ছিল দ্বিতল।
প্রবেশপথ এলাকায় দুপাশে নিচতলায় প্রত্যেকভাগে ৫টি করে ভল্টেড কক্ষ রয়েছে যেগুলিতে বর্তমানে সাদা পলেস্তরা করা হয়েছে। প্রত্যেক দিকের শেষ দুটি কক্ষ থেকে উত্তরভাগে কিছু অংশ কেটে নিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ১টি করে আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। এ কক্ষসমূহ ভল্টযুক্ত নয় এবং এগুলির সামনে আছে টানা বারান্দা।
দক্ষিণ ব্লকের দুকোণে দুটি বিরাট টাওয়ার রয়েছে। অষ্টকোণাকৃতির টাওয়ারসমূহ ফাঁকা প্যানেল অলংকরণ সম্বলিত এবং ব্যাস ৩.০৪/৩.০৪ মি.। কোণার কক্ষসমূহ থেকে এ টাওয়ার দুটিতে যাওয়া যায়।
বড় কাটরার সংস্কার সাধনে মালিকগণ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার আদি ভবনের বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। নতুন বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। পরবর্তী এ সংযোজনের ফলে নতুন হতে পুরাতনকে পৃথক করা দুঃসাধ্য। তবুও এটি এখনও স্থপতির অসাধারণ শিল্পচাতুর্যের পরিচয় দেয়। বস্ত্তত, বড় কাটরা ভবনটি বাংলাদেশে মুগল অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
ছোট কাটরা ঢাকার বড় কাটরা হতে প্রায় ১৮৩ মি. পূর্ব দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি নওয়াব শায়েস্তা খান ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। বড় কাটরা যে উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল, প্রায় সে উদ্দেশ্যেই ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল। পরিকল্পনায় ও নির্মাণ কৌশলে ছোট কাটরা অবিকল বড় কাটরার মতো। কিন্তু আকারে ছোট। আয়তাকৃতির ছোট কাটরার পরিমাপ বাইর থেকে ১০১.২০ মি/ ৯২.০৫ এবং ভেতরে ৮১.০৭ মি/ ৬৯.১৯মি। এর বাইরের প্রাচীর ০.৯১ মি থেকে ১মি পুরু এবং এর প্রতিরক্ষা বুরুজের দেওয়াল যেখানে সবচেয়ে পুরু সেখানে হলো ১.২২ মিটার। ছোট কাটরার উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। এর মধ্যে দক্ষিণেরটি প্রধান প্রবেশপথ।
ছোট কাটরার খিলানসমূহ তিনভাঁজ বিশিষ্ট। মিনারগুলি মজবুত এবং অন্যান্য মুগল মিনারের তুলনায় মোটা ও বপ্রবিহীন। প্রাসাদের সিঁড়ি ও মেঝে কাঠ দিয়ে তৈরী। কাঠের সিঁড়িগুলি ছিল বেশ চওড়া। একতলায় একটি কক্ষকে বিভক্ত করা হয়েছে আড়াআড়িভাবে-একটি লম্বা ও অপরটি চওড়া দ্বিতল অত্যুচ্চ প্রবেশপথ দুট সংস্কার করা হলেও এখনও প্রবেশপথ দুটি চিত্তাকর্ষক। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণবেষ্টিত চারপাশের ভবনাদি বহুবার নবায়ন, পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। আদি ভবনে অনেক আধুনিক সম্প্রসারণ হয়েছে। নদীর দিকে তিনতলা বিশিষ্ট প্রবেশপথে কিছু ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। ত্রয়ী জানালায় ও সুউচ্চ পার্শ্ব বুরুজে পরবর্তী সংস্কারের সময় ঔপনিবেশিক প্রভাবের প্রতিফলন ঘটেছে।
বিবেচনাহীন পরিবর্তন ও অনাকাঙ্ক্ষিত নবায়ন এবং প্রাঙ্গণে দোকান-পসারের ঘেষাঘেষিতে এর পূর্ব আকৃতি ও সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়ে গেছে।
অন্যান্য কাটরা ঢাকায় আরও অনেকগুলি কাটরার নাম পাওয়া যায়, যেমন মুকিম কাটরা, বকশীবাজার কাটরা, মুঘলটুলি কাটরা, মায়া কাটরা, নওয়াব কাটরা, নাজির কাটরা, রহমতগঞ্জ কাটরা, ক্যারাভান ও বাদামতলী কাটরা প্রভৃতি।
মুকিম কাটরা মুকিম কাটরা মহল্লাটির কিছু অংশ মৌলভী বাজার ও বাকিটা চকবাজারে অবস্থিত। কিন্তু এলাকাটিকে এখনও মুকিম কাটরা বলা হয়। এলাকাটি মির্জা মুকিমের নাম অনুসারে হয়েছিল। তিনি এ কাটরা ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে মীরজুমলার শাসনকালে তৈরি করেন। এ কাটরার অস্তিত্ব এখন আর নেই।
মালদহের কাটরা ফিরোজনূর মহল্লায় অবস্থিত। কাটরার ফটকগুলি অত্যন্ত মজবুত করে তৈরি করা হয়েছিল এবং এখনও কাটরার খিলানগুলির কিছু অংশ অক্ষতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরের কক্ষগুলি বর্তমানে ভগ্নদশায় রয়েছে। খুব সম্ভব এ কাটরা সম্রাট আকবর এর সময় নির্মাণ করা হয়। [রাশেদা ওয়ায়েজ ও আয়শা বেগম]