কলকাতা মাদ্রাসা

কলকাতা মাদ্রাসা (পরবর্তীকালে আলিয়া মাদ্রাসা)  ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতে রাষ্ট্রীয়-ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সর্বপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৭৮০ সালে অক্টোবরে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসএটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেড় বছর যাবৎ এর সম্পূর্ণ খরচ নিজে বহন করেন, যদিও পরবর্তী সময়ে এর পুরোটাই তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়। ১৭৮০ সালের এপ্রিলে বেঙ্গল প্রেসীডেন্সী সরকার এর পরিচালনা দায়িত্ব গ্রহণ করে। শুরুতে কলকাতা নগরীর শিয়ালদার নিকটে, একটি বাড়ীর বৈঠকখানায় স্থাপিত হলেও ১৮২৭ সালে এর বর্তমান অবস্থান ওয়েলেসলী স্কোয়ারে এটিকে স্থানান্তরিত করা হয়। এর প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইসলামি শিক্ষায় বড় পন্ডিত মোল্লা মাজদুদ্দিন। ১৭৯১ সালে মুহম্মদ ইসমাইল তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এ মাদ্রাসা স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফারসি ও আরবি ভাষায় এবং মুসলিম আইন (ফিকাহ্) শাস্ত্রে শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি করা, যাদেরকে সরকারি অফিসে ও বিচারালয়ে নিম্নপদে নিয়োগ করা যাবে। বিশেষত মুসলিম আইনের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে তারা কাজ করতে পারবেন। এভাবে বাংলার বিরূপ মুসলিম অভিজাত সম্প্রদায়কে খুশি করার উদ্দেশ্যও ছিল, কারণ তাঁদের সন্তানদের জন্য সম্ভাবনাময় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

মাদ্রাসার ব্যাপারে প্রথম প্রত্যক্ষ আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ঘটে ১৭৯০ সালে, যখন অব্যবস্থাপনা ও ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতার ব্যাপক অভিযোগের পটভূমিতে ২৪ পরগণার কালেক্টর মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তদন্তের পর প্রধান শিক্ষক মাজদুদ্দিনকে ১৭৯১ সালে অপসারণ করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার ভার রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে তিন-সদস্যের একটি কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। মাদ্রাসার প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে ১৮১৯ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন অ্যায়রনকে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সচিব নিয়োগ করা হয়। ১৮৪২ সালে এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। মাদ্রাসাটিকে নিরবচ্ছিন্ন অবনতির প্রবাহ থেকে উদ্ধার করতে ১৮৫০ সালে প্রথমবারের মতো একজন ইউরোপীয় ড. অ্যালয়স স্প্রেঞ্জারকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাঁর পরে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন এ এইচ হার্লি, যিনি ১৯১০-১১ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

কলকাতা মাদ্রাসা শুরু থেকেই লখনৌয়ের প্রখ্যাত আরবি স্কুল ফিরিঙ্গি মহলের ‘দারসে নিয়ামিয়া’-এর মডেল অনুসরণ করে পাঠদানের কোর্স প্রণয়ন করে। ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার পাঠক্রমে ফারসি ভাষা আরবির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে মুখ্য স্থান দখল করে। তখনকার দিনে ‘মূর্তি পূজার ভাষা’ হিসেবে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। ত্রৈরাশির দ্বৈত নিয়ম অর্থাৎ অনুপাত ও সমানুপাত পর্যন্ত গণিত শিখানো হতো, এবং ইউক্লিডের শুধু একটি পাঠ পড়ানো হতো। মাদ্রাসার সিলেবাসে ইতিহাস, ভূগোল, এমনকি তাফসির ও হাদিসেরও কোনো স্থান ছিল না। অ্যারিস্টোটলের পুরাতন দার্শনিক মতের অনুরূপ চিন্তাধারার আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের কোর্সসমূহ গুরুত্বহীন ভাবে পড়ানো হতো।

১৮২৬ সালে প্রবর্তিত প্রাথমিক ইংরেজি কোর্সসমূহ প্রবর্তন থেকে শুরু করে কতিপয় সংস্কার প্রচেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। ১৮২৬ সাল থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত পঁচিশ বছরেরও অধিক সময়ে মাদ্রাসাটি শুধু দুজন নিম্নপদস্থ ইংরেজি শিক্ষিত পন্ডিত (নওয়াব) আবদুল লতিফ ও ওয়াহিদুন্নবী তৈরি করতে পেরেছে। ১৮৬৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় এফ.এ. পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত হলে তা’ও দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়। এগুলি ১৮৬৯ সালে স্থগিত রাখা হয় এবং অবশেষে ১৮৮৮ সালে পরিত্যাগ করা হয়। আরেকটি সংস্কার প্রচেষ্টা ছিল ১৮৫৪ সালে মাদ্রাসার মধ্যে একটি পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা। এখানে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভর্তি সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে শরাফতনামা (উচ্চ বংশে জন্মের সনদপত্র)-র উপর জোর দেওয়া হতো। তবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ মুসলিম অভিজাতদের মধ্যে তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। উচ্চ ইংরেজি স্কুলের মানের অনুরূপ মান বজায় রেখে এবং ফারসি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইঙ্গ-ফারসি বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদেরকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। ১৮২১ সালে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে মাদ্রাসায় আনুষ্ঠানিক (formal) পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৮৫৪ সালের শিক্ষাসংক্রান্ত ‘ডেস্পাচ’-এ কলকাতা মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার ইঙ্গিত থাকলেও মাদ্রাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা হয়নি। এভাবে কলকাতা মাদ্রাসা উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিচ্ছিন্ন ধারা হিসেবে বেড়ে ওঠে।

একথা বলা আবশ্যক, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কলকাতা মাদ্রাসা কার্যত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল যা প্রায় এক শতাব্দীকাল, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও, প্রশংসনীয় সংখ্যক মুসলিম ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল।  [বি.আর খান]