কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ভারত সরকার কর্তৃক ১৯১৭ সালে গঠিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদি তদন্ত করে দেখা এবং অভিজ্ঞ মহলের মতামতের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-দীক্ষা ও সংগঠনের জন্য করণীয় কাজ নির্ধারণের নিমিত্তে সুপারিশ পেশ করা ছিল কমিশনের উদ্দেশ্য। লীড্স্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম.ই স্যাডলার ছিলেন কমিশনের সভাপতি। স্বনামধন্য জে.ডব্লিউ গ্রেগরী, স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, প্রফেসর র‌্যামজে মুর, স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ডব্লিউ.ডব্লিউ হর্নওয়েল এবং জিয়াউদ্দীন আহমদ ছিলেন কমিশনের অন্যান্য সদস্য। জি অ্যান্ডারসন কমিশনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯১৭ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্যাডলার কমিশন প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করে। কমিশনের সভাপতির পরামর্শক্রমে সদস্যেরা ভারতবর্ষের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেন এবং ১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ ভারত সরকারের কাছে বিশালাকার রিপোর্ট পেশ করেন।

কমিশনের প্রধান সুপারিশমালা বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় সকল দিকের ওপর আলোকপাত করে। কমিশন মনে করে মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ পুনর্গঠন ছাড়া বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে সন্তোষজনকভাবে ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়, কারণ মাধ্যমিক শিক্ষার ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নির্ভরশীল।

কমিশন প্রস্তাব করে, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব উচ্চ মাধ্যমিক কলেজসমূহের ওপর ন্যস্ত করা উচিত। কমিশন একটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের সুপারিশ করে। এ বোর্ড-এর পরামর্শক কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হবেন বেসরকারি পদমর্যাদার এবং এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বোর্ডের সভাপতি হবেন বেতনভোগী ও সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। গণশিক্ষা বিভাগের পরিচালক পদাধিকারবলে এর সদস্য হবেন।

কমিশন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা যথাশীঘ্র বাস্তবায়ন করা ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভূমিকা হবে শিক্ষাদান। এটি অধিভুক্ত কলেজসমূহকে নিয়ে গঠিত হবে। এ কলেজগুলির কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণভার থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে। অধিভুক্তির শর্তাবলি বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। প্রেসিডেন্সি কলেজ অধিভুক্ত কলেজের মধ্যে অগ্রগণ্য বিবেচিত হবে। এ কলেজের নামে কমপক্ষে দশটি অধ্যাপকের পদ থাকবে এবং এ কলেজের শিক্ষকই সে পদগুলি পূরণ করবেন।

কমিশন মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি ইসলামিয়া কলেজ গঠনের সুপারিশ করে। এ কলেজে আরবি, ফারসি ও ইসলামের ইতিহাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও প্রভাষকের পদ যুক্ত থাকবে। কমিশন একটি রক্ষণশীল হিন্দু কলেজ স্থাপনেরও প্রস্তাব করে।  সংস্কৃত কলেজএর স্নাতক বিভাগ যেখানে সংস্কৃত ও পালি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও রীডারের পদমর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকেরা যুক্ত আছেন সেটির ভিত্তিতে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

বাংলাদেশ জুড়ে ছড়ানো ছিটানো মফস্বল কলেজের জন্য কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধনের প্রস্তাব করে। কমিশন মফস্বল অঞ্চলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়োজন অনুধাবন করেছিল। তিন বছর স্থায়ী অনার্স শিক্ষাক্রম কমিশনের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অধ্যাপক ও রীডার নিয়োগের জন্য কমিশন বহিরাগত বিশেষজ্ঞসহ বিশেষ নির্বাচনী কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছিল।

কমিশনের প্রস্তাবে ছাত্রদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য অধ্যাপকের বেতন ও পদমর্যাদা সম্পন্ন শারীরিক শিক্ষা পরিচালকের একটি পদ সৃষ্টি ও একটি ছাত্রকল্যাণ বোর্ড গঠনের কথা ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ বোর্ড গঠনের জন্যও আহবান জানিয়েছিল কমিশন। পেশাগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথাও কমিশনের প্রস্তাবে উহ্য ছিল না। কমিশন প্রাচ্যবিদ্যার জন্য একটি বিভাগ চালুর সুপারিশ করে। চিকিৎসা শাস্ত্রে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে কমিশন। কমিশনের প্রস্তাবে একটি ডেন্টাল কলেজ স্থাপনের বিষয়টি স্থান পায়। শিবপুর সিভিল ইনজিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে সেখানে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইনজিনিয়ারিং, খনিবিদ্যা ও স্থাপত্যবিদ্যার প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

তরুণদের জীবিকার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য একটি কৃষিবিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়। কমিশন মাতৃভাষায় বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিল। ঢাকা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি এবং মাধ্যমিক, বি.এ ও এম.এ পরীক্ষায় শিক্ষাকে একটি পঠিত বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা কমিশনের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল। সবশেষে শিল্পক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতির জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। বস্ত্তত, শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, সারা ভারতের শিক্ষাপ্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য স্যাডলার কমিশনের সুপারিশমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  [রচনা চক্রবর্তী]