কর্মকার, কালিদাস
কর্মকার, কালিদাস (১৯৪৬-২০১৯) বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চিত্রশিল্পী। চিত্রকলার রঙ ও উপকরণ ব্যাবহারে দক্ষ শিল্পী তিনি। চিত্রকলা ও ছাপচিত্র মাধ্যমে নিরীক্ষণ ধর্মী কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেন। কালিদাস কর্মকার ১৯৪৬ সালের ১০ই জানুয়ারি ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবাসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য আঁকাআঁকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারাও শিল্পী হতে পারতেন। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রতিভা বিকশিত হয়নি। কালিদাসের শিল্পী হওয়ার আগে উদ্ভিদবিদ্যার ওপর প্রবল আকর্ষণ ছিল। কারণ তখন তার পরিবারের অগ্রজ সদস্যরা কবিরাজিও করতেন। তারা বিভিন্ন গাছ-গাছালির শিকড়-বাকড়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কালিদাস ছিলেন মেধাবী ও ডানপিটে। শিল্পী পরিবারে (কর্মকার) জন্ম নেয়া কালিদাসের রক্তেই যেন আছে শিল্পসত্তা। পারিবারিকভাবেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন কারুশিল্প দেখে। সেখান থেকেই শিল্পের প্রতি আগ্রহ। ১৯৬০ সালে তিনি কাকতালিয়ভাবে ঢাকায় চলে আসেন। সেদিনই ছিল চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা। চলে গিয়েছিলেন তিনি পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষায় তাঁকে এক ঘন্টায় একটি গাছ এঁকে দিতে বলা হয়েছিল। শিক্ষককে অবাক করে দিয়ে ১০ মিনিটে একটি গাছ এঁকে দিয়েছিলেন। কালিদাস কর্মকার সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)-এ ভর্তি হন ১৯৬২ সালে। সেখান থেকে দুই বছরের প্রি-ডিগ্রি সম্পন্ন করে চলে যান ভারতে। কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৯ সালে। মাতৃভূমির টানে ১৯৭১ সালে আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশে। পোল্যান্ড সরকারের বৃত্তি নিয়ে ওয়ারশ ইউনিভার্সিটির ওয়ারশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসে গ্রাফিক আর্ট বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ফ্রান্স সরকারের বৃত্তি প্যারিসে আতেলিয়া-১৭-তে তিনি ফাইন আর্টসে গবেষণা করেন। জাপান ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপে উডব্লক প্রিন্টিং বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন টোকিওর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস এন্ড মিউজিকে। আইসিসিআর বিশেষ বৃত্তি নিয়ে গবেষণা করেন পশ্চিমবঙ্গ ললিতকলা একাডেমি স্টুডিওতে। তিনি এশিয়ান কালচারাল কাউন্সিল, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ফোলোশিপ লাভ করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে কয়েক বছর তিনি জাপানে অবস্থান করেছেন। সেই সময়ে তিনি জাপানের ঐতিহ্যবাহী ওয়াশি পেপার নির্মাণ পদ্ধতি শিখেন। এটি হচ্ছে নিজ হাতে কাগজের মন্ড ও কাগজ তৈরির এক বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কাগজ তৈরি করে তার মধ্যে দিয়েছেন তাবিজ, কড়ি, নানা রঙের সুতা, গাছের শেকড়সহ নানা উপাদান। নানা উপাদান ও নানা লৌকিক উপকরণ মিলিয়ে তার কাজে নিজস্ব ভাষা স্পষ্ট। পরে তিনি তার ক্যানভাসে নানা রকম অভিনশ্বর উপাদান ব্যাবহার করে। রঙের বেলায় ছিলেন মুক্তহস্ত। ক্যানভাসে রঙ ছড়িয়েছেন প্রাণখুলে। সেটা আবার পরিমিতি বোধের বাইরে নয়। তবে সাদা আর কালো রঙের প্রতি ছিল তার পক্ষপাত।
তিনি একজন আইকনিক পেশাদার শিল্পী। একমাত্র ছবি আঁকা নিয়েই মেতে ছিলেন সারা জীবন। শিল্পকলা নিয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করেছেন দীর্ঘ জীবন। ক্যানভাসে নানা রকম নিরীক্ষামূলক কাজে পটু ছিলেন তিনি। নিরীক্ষণ করেছেন চিত্রকলার বিষয়, ক্যানভাস ও উপাদান নিয়ে। তাঁর প্রদর্শনীগুলো ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। সে প্রদর্শনীতে ইনস্টলেশনও স্থান পেয়েছে। অনেক প্রদর্শনীতে নিজেই শিল্পকর্ম হয়ে উপস্থিত হয়েছেন। নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন ডিসি, ওসাকা, টোকিও, ইনোশিমা, কফু, তেহরান, দিল্লি, কলকাতা, রোম, বেইজিং, প্যারিস, কানাডা, হংকং, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, পোল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে একক এবং অনেকগুলি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী করেছেন তিনি। ২০১৬ সালে জাতীয় জাদুঘরে একক প্রদর্শনীতে সুরের মুর্ছনার সঙ্গে ছবি এঁকে ভিন্নমাত্রা যোগ করেন।
তার শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দুতাবাস, পোল্যান্ডের এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক ও ওয়ারশো একাডেমি অব ফাইন আর্টস, ফুকুওকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম, তেহরান মিউজিয়াম অব কনটেম্পরারি আর্ট, জাকার্তা আর্ট কাউন্সিল, বালি আর্ট সেন্টার, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, বেইজিং, টোকিও, প্যারিস, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, আরব বংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, চলচিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম করপোরেশন, ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ ইয়র্ক, কোরিয়ার ইয়ংওয়ান করপোরেশন এবং তেহরানসহ দেশে-বিদেশে বহু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে।
তিনি বাংলাদেশ ছাড়াও তেহরান, জাপান, প্যারিস, পোল্যান্ড এবং কলকাতাসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন ২০১৮ সালে।
প্রতিভাধর এই শিল্পী ২০১৯ সালের ১৮ই অক্টোবর পরোলোক গমন করেন। [হামিদুজ্জামান খান]