করিম, নাজমুল

নাজমুল করিম

করিম, নাজমুল (১৯২২-১৯৮২) শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর পূর্ণনাম আবুল খায়ের নাজমুল করিম। তিনি অবিভক্ত বাংলার নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুর থানা সদরে ১৯২২ সালের ১ আগস্ট এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবু রশীদ্এবং মাতার নাম শামসুন নেছা। তাঁর পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত ফাল্গুনকরা গ্রাম।

নাজমুল করিম শিক্ষার সকল স্তরেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি পাঁচ বছর ফেনী কলেজ ও ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার নিযুক্ত হন। একই সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগপৎ ‘সরকার’ ও ‘সমাজবিজ্ঞান’ বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৫৩ সালে বিষয় দুটিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠার সাথে নাজমুল করিম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি উক্ত সালের ১৯ আগষ্ট সমাজবিজ্ঞান বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পদে ২৫ বছর অধ্যাপনা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যয়ন কালেই নাজমুল করিম দুটি প্রবন্ধ‘ধর্মের বিবর্তন ও মার্কসবাদ’(অরণি, কলকাতা, ১৪ এপ্রিল ১৯৪৪) এবং ‘ভূগোল ও ভগবান’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিকী, ১৯৪৬) প্রকাশ করে বিদ্বৎকুলের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রবন্ধ দুটিতে নাজমুল করিমের র‌্যাডিক্যাল চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটে। তাঁর এম.এ অভিসন্দর্ভ চেঞ্জিং সোসাইটি ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান গ্রন্থাকারে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী ডব্লিউ.এ গারস্টিন লন্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে গ্রন্থটির সপ্রশংস পর্যালোচনা করেন।

১৯৬০ এবং ১৯৬২ সালে অধ্যাপক ড. পেরী বেসাইনি ও অধ্যাপক ড. জন. ই ওয়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দু’জন অধ্যক্ষ-এর সম্পাদনায় ঢাকাস্থ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক যে দু’টি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাতেও নাজমুল করিম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রথম গ্রন্থের সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রথম প্রবন্ধ এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের সমাজতত্ত্ব অংশের প্রথম প্রবন্ধ ও ক্ষেত্র-গবেষণা অংশের দ্বিতীয় প্রবন্ধের লেখক ছিলেন নাজমুল করিম। তিনি এ সকল প্রবন্ধে সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতি, উন্নয়নের লক্ষ্য ও সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে যে মতামত ব্যক্ত করেন তা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী বলে বিবেচনা করা যায়।

তিনি দেশ-বিদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ পাঠ করেন।  এসবের  মধ্যে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হচ্ছে ‘চেঞ্জিং প্যাটার্নস অব এন ইস্ট পাকিস্তান ফ্যামিলি’, উইম্যান ইন দি নিউ এশিয়া, সম্পাদিত: বারবারা ওয়ার্ড, ইউনেস্কো, প্যারিস, ১৯৬৫; সোস্যাল সায়েন্স ইন বাংলাদেশ ইউনেস্কো, প্যারিস, ১৯৭৪ ও রিলিজিয়ন অ্যান্ড সোসাইটি ইন বাংলাদেশ, রিলিজিয়ন ইন ওরিয়েন্টাল সোসাইটিজ, মনটন প্রেস, কানাডা। নাজমুল করিমের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ‘দি মডার্ন মুসলিম পলিটিক্যাল এলিট ইন বেঙ্গল’ ১৯৮০ সালে দি ডিনামিক্স অব বাংলাদেশ সোসাইটি শিরোনামে দিল্লিতে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিদেশের জার্নাল ও গ্রন্থে প্রকাশিত নাজমুল করিমের বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ছয়। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃত নাজমুল করিমের মুত্যু ১৯৮২ সালের ১৮ নভেম্বর।  [রংগলাল সেন]