কবরী, সারাহ বেগম

Sarah Begum Kabari

কবরী, সারাহ বেগম (১৯৫০-২০২১) জনপ্রিয় অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং রাজনীতিবিদ। তবে তাঁর প্রধান পরিচয় অভিনেত্রী হিসেবেই। বিশ শতকের ষাট ও সত্তর, এমনকি আশির দশকে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়িকা ছিলেন। সারাহ বেগম কবরীর পারিবারিক নাম ছিল মীনা পাল। অভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রে তিনি কবরী নামেই সুপরিচিত। জানা যায় যে, কবরী অভিনীতি প্রথম চলচ্চিত্র ‘সুতারং’-এর কাহিনীকার, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মীনা নামটি পরিবর্তন করে তাঁর ‘কবরী’ নাম রাখেন।

শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল দম্পতির কন্যা মীনা পালের (কবরী) জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলায়। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। চিত্ত চৌধুরীর সাথে তিনি প্রথমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে এ বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থায়ী হয়নি। চিত্ত চৌধুরীর সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর, ১৯৭৮ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের সাফিউদ্দিন সারওয়ারকে বিয়ে করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে সারাহ বেগম কবরী বা কবরী সারওয়ার নাম ধারণ করেন। ২০০৮ সালে এ বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তিনি সারাহ বেগম কবরী নামটিই ব্যবহার করতেন।

১৯৬৩ সালে একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে সাংস্কৃতি জগতে কবরীর পদচারণা শুরু হয়। তবে চলচ্চিত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম চলচ্চিত্রেই অভিনয় শিল্পী হিসেবে তিনি বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন। এরপর অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ের অভিনয় জীবনে কবরী দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক রাজ্জাকের সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে তিনি ৪১টি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বলা হয়, সে সময়ে উর্দু চলচ্চিত্রে শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিম জুটির মতো জনপ্রিয় জুটির সাথে পাল্লা দিয়ে রাজ্জাক-কবরী জুটি বাংলা চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। রাজ্জাক ছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অন্যান্য নায়কদের সাথেও তিনি অনেক সফল চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এমনকি তাঁর বিপরীতে নায়ক হিসেবে সিনেমায় অভিষেক ঘটেছিল চিত্রনায়ক আলমগীর, উজ্জল, জাফর ইকবাল, সোহেল রানা ও ফারুকের। ঢাকার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এটিও বিরল ঘটনা।

কবরী অভিনীত জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বাহানা’ (১৯৬৫), ‘হীরামন’ (১৯৬৭), ‘সাত ভাই চম্পা’ (১৯৬৭), ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’ (১৯৬৮), ‘আবির্ভাব’ (১৯৬৮), ‘আগন্তুক’ (১৯৬৮), ‘ময়নামতি’ (১৯৬৮), ‘পারুলের সংসার’ (১৯৬৯), ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৬৯), ‘যে আগুনে পুড়ি’ (১৯৭০), ‘দ্বীপ নেভে নাই’ (১৯৭০), ‘দর্পচূর্ণ’ (১৯৭০), ‘কাঁচ কাটা হীরা’ (১৯৭০), ‘বিনিময়’ (১৯৭০), ‘জলছবি’ (১৯৭১), ‘জয় বাংলা’ (১৯৭২), ‘লালন ফকির’ (১৯৭২), ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩), ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৩), ‘রংবাজ’ (১৯৭৩), ‘মাসুদ রানা’ (১৯৭৪), ‘অবাক পৃথিবী’ (১৯৭৪), ‘অধিকার’ (১৯৭৪), ‘সুজন সখী ’(১৯৭৫), ‘মতিমহল’ (১৯৭৭), ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮), ’বধূ বিদায়’ (১৯৭৮), ‘আরাধনা’ (১৯৭৯), ‘কলমি লতা’ (১৯৮১), ‘দেবদাস’ (১৯৮২), ‘দুই জীবন’ (১৯৮৭), ‘আয়না’ (২০০৬) এবং ‘রাজা সূর্য খাঁ’ (২০১২) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য৷ শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, কবরী ছোট পর্দার টেলিভিশনেও অভিনয় শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত কবরী অভিনীত জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে ‘সংশপ্তক’ (৭ পর্বে), ‘যেখানে তারার আলো’ এবং ‘মাটির কোলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কবরী শুধু একজন অভিনেত্রীই ছিলেন না, পরিচালক ও প্রযোজকও ছিলেন। ‘একাত্তরের মিছিল’ (২০০১) নামে তিনি প্রথম একটি শর্টফিল্ম পরিচালনা করেছিলেন। ২০০৬ সালে ‘আয়না’ নামক চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র পরিচালনায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। অ্যাসিড সন্ত্রাস নিয়ে নির্মিত ‘আয়না’ সিনেমাটি পরিচালক হিসেবে তাঁকে প্রশংসা ও স্বীকৃতি এনে দেয়। সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বিভিন্ন শাখায় সম্মাননা লাভ করে। এর জন্য কবরী নিজে অর্জন করেন ‘মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার’। ২০১৯ সালে সরকারি অনুদানে ‘এই তুমি সেই তুমি’ নামক একটি ছবি পরিচালনা শুরু করেছিলেন কবরী। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে এটি আর শেষ করতে পারেননি। অভিনয় জীবনের কয়েক বছরের মাথায় তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রযোজক হিসেবেও। ‘শীত-বসন্ত’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্রযোজনায় যাত্রা হয়েছিল তাঁর। কবরীর নিজের প্রডাকশন হাউজের নাম ছিল প্রথমে ‘শ্রীমতি’। পরে এর নাম পরিবর্তন করে ‘কবরী প্রডাকশন’ নামকরণ করা হয়। ‘গুন্ডা’ (১৯৭৬) ছিল কবরী প্রযোজিত শেষ ও অন্যতম ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র।

কবরী ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ নামে খ্যাত। তাঁর ভুবন ভোলানো হাসি এবং হৃদয়ছোঁয়া দক্ষ অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তাঁর সিনেমার দর্শকরাই তাঁকে এ আখ্যা দিয়েছিলেন। বলা হয়, কবরীর মিষ্টি হাসির আবেদন, চেহারার সরলতা এবং অভিনয়ে নিষ্ঠা তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রীর মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে কবরী কেবল দর্শকদের ভালোবাসাতেই সিক্ত হননি, দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও সমালোচকদেরও প্রশংসা পেয়েছেন। তিনি তাঁর কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৭৮ সালে শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সারেং বউ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন কবরী। ‘লালন ফকির’ (১৯৭২), ‘সুজন সখী’ (১৯৭৫), ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮) এবং ‘দুই জীবন’ (১৯৮৮) সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে চার বার ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার’ (বাচসাস পুরস্কার) লাভ করেন। ‘মেরিল-প্রথম আলো লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ দ্বারাও তাঁকে সম্মানিত করা হয়। কবরী অভিনীত একটি সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত) এবং ‘সাতভাই চম্পা’ (১৯৬৮) ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা সেরা দশ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তালিকায় যথাক্রমে প্রথম ও দশম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবিসংবাদিত অভিনেত্রী কবরীর নামে চুয়াডাঙ্গা শহরে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘কবরী রোড’।

শুধু সংস্কৃতি অঙ্গনেই নয়, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে কবরী বাংলাদেশের রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক অঙ্গনের সঙ্গে সে সময় তাঁর কোনো সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও একজন রাজনীতি সচেতন ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭১ সালে কবরী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অভিনয় ও রাজনীতি ছাড়াও তিনি অনেক নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় শিশু সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা’র প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা হিসেবে।

কবরীর পেশাগত, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবন অতিবাহিত হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। তিনি তাঁর জীবনের লেখচিত্র অংকন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ স্মৃতিটুকু থাক-এ। ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় তাঁর এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

২০২১ সালের ২১শে এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারাহ বেগম কবরী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]