ওলাদেবী

ওলাদেবী  অন্যতম লৌকিক দেবতা। ময়দানবের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত ওলাদেবী ওলাউঠা বা বিসূচিকা বা  কলেরা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিনি ওলাইচন্ডী, ওলাবিবি, বিবিমা ইত্যাদি নামেও পরিচিত। অতীতে প্রায়শই ওলাউঠা রোগ মহামারী আকারে দেখা দিত এবং এতে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটত। তাই এ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পল্লিবাসীরা ওলাদেবীর পূজা করত।

ওলাদেবী অসাম্প্রদায়িক দেবতা অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এঁর পূজা করা হতো। তবে দেবীর মূর্তি ও পূজাপদ্ধতিতে কিছুটা পার্থক্য ঘটত। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এঁর আকৃতি হতো লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো, গায়ের রঙ গাঢ় হলুদ বর্ণ, হাত দুটি প্রসারিত, কখনও দন্ডায়মান, কখনওবা শিশুসন্তান ক্রোড়ে নিয়ে আসনে উপবিষ্টা, পরনে সাধারণত নীল শাড়ি এবং সর্বাঙ্গে নানা প্রকার অলঙ্কার। এঁর কোনো বাহন নেই।

মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে ওলাদেবীর আকৃতি ও পোষাকে ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। সেখানে এঁর মূর্তি অভিজাত ঘরের কোনো সুন্দরী কিশোরীর মতো, পরনে পিরান, পাজামা, টুপি, ওড়না এবং গায়ে নানা প্রকার অলঙ্কার। এ ছাড়া পায়ে থাকে নাগরা জুতা এবং কখনও কখনও মোজাও। এঁর এক হাতে থাকে আসাদন্ড যা দিয়ে ভক্তের মুশকিল আসান করেন।

ওলাদেবীর পূজা এককভাবেও হয় আবার ঝোলাবিবি, আজগৈবিবি, চাঁদবিবি, বাহড়বিবি, ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি এ ছয়জনের সঙ্গে একত্রেও হয়। এঁদের একত্রে বলা হয় সাতবিবি। কারও কারও মতে এঁরা ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বারাহী, ইন্দ্রাণী প্রভৃতি পৌরাণিক দেবীর লৌকিক রূপ। এঁদের একত্র পূজার প্রথা প্রাগৈতিহাসিক যুগেও প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়, কারণ মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত একটি মৃণ্ময় ফলকে সাতটি নারীমূর্তি পাশাপাশি দন্ডায়মান দেখা যায়।

সাতবিবির মধ্যে ওলাদেবীই প্রধান; ভক্তরা তাঁর উদ্দেশ্যেই পূজা দেয়, তবে অন্যরাও সে পূজার ভাগ পায়। ওলাদেবীর পূজা হয় পল্লীর বৃক্ষতলে পর্ণকুটিরে। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে শনি অথবা মঙ্গলবারে পূজা হয় এবং পূজায় নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। পূজার পৌরোহিত্যে যেকোনো বর্ণ বা সম্প্রদায়ের লোকের, এমন কি নারীরও অধিকার আছে। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে এঁকে ওলাবিবি বা বিবিমা নামে মানত করা হয়। হাড়ি বা ডোম-প্রধান অঞ্চলে তারাই পৌরোহিত্য করে এবং সেখানে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকে। ওলাদেবীর পূজা তিন রকম। শনিবার ও মঙ্গলবার অনাড়ম্বরে যে পূজা হয় তা বারের পূজা নামে পরিচিত। কারও মানত উপলক্ষে সামান্য আড়ম্বরের সঙ্গে যেকোনো সময় এঁর পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া কোথাও কলেরা রোগ মহামারী আকারে দেখা দিলে সে এলাকার লোকজন গ্রামের মোড়লের নেতৃত্বে সমষ্টিগতভাবে এঁর পূজা দেয়।

ওলাদেবীর পূজায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। হিন্দু-মুসলমান এক সঙ্গে একই পুরোহিতের হাতে পূজার নৈবেদ্য ও মানতের দ্রব্য প্রদান করে। পুরোহিত নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা মুসলমান হলেও কেউ তাঁর নিকট থেকে নৈবেদ্য গ্রহণে দ্বিধা করে না। ওলাদেবীর নৈবেদ্য অতি সাধারণ সন্দেশ, বাতাসা ও পান-সুপারি; কোথাও কোথাও আতপ চাল ও পাটালিও দেওয়া হয়। এ পূজায় বিশেষ কোনো মন্ত্র নেই; তবে কোনো কোনো হিন্দু পুরোহিত পূজার সময় ‘এসো মা ওলাদেবী, বেহুল রাঢ়ির ঝি’ এরূপ আবেদন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লীতে একসময় খুব গুরুত্বের সঙ্গে ওলাদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভাবে সমাজ থেকে এসব আচার এক প্রকার উঠে গেছে বলা যায়।  [পরেশচন্দ্র মন্ডল]