ওয়ালিপুর আলমগীরী মসজিদ
ওয়ালিপুর আলমগীরী মসজিদ চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত ওয়ালিপুর গ্রামে অবস্থিত। এখানে একই এলাকায় দুটি মসজিদ রয়েছে; একটি শাহী বা আলমগীরী মসজিদ এবং অপরটি শাহ শুজা মসজিদ। আলমগীরী মসজিদটি পরবর্তী সময়ে একাধিক সংস্কারের ফলে তার অনেক আদি বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। তবে এখনও যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা থেকে এর মূল পরিকল্পনা ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। প্রধান প্রবেশপথের উপরে সংলগ্ন নাস্তালিক লিপিতে ফারসি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জনৈক আবদুল্লাহ ১৬৯২ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেব এর শাসনামলে এটি নির্মাণ করেন।
আয়তাকার মসজিদের (১৫.২৪ মি × ৮.২৩ মি) পূর্বদিকের সম্মুখভাগের মধ্যবর্তীস্থানে প্রান্তে অষ্টভুজাকার ক্ষুদ্র বুরুজসহ একটি উদ্গত ফ্রেমে আয়তাকার প্রধান প্রবেশপথ উঁচু খিলান ও অর্ধগম্বুজ শোভিত। প্রধান প্রবেশপথের দুপাশে অর্ধগম্বুজের নিচে বহির্গত খিলানসহ আরও দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। উত্তর দক্ষিণের প্রতিটি দেয়ালে রয়েছে এক জোড়া খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। সুতরাং মসজিদটিতে সর্বমোট ৭টি খিলানপথ রয়েছে; পূর্বদিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে। ইমারতের চার কোণে ইদানীং সংস্কার সাধিত অষ্টভুজাকার চারটি বুরুজ রয়েছে। আনুভূমিক প্যারাপেট ছাড়িয়ে এগুলি উঠে গেছে এবং এগুলি কলসাকৃতির ফিনিয়াল দ্বারা শোভিত।
দুটি বড় অষ্টকোণাকার ইটের স্তম্ভ মসজিদের অভ্যন্তর ভাগকে পাঁচটি বর্গাকার ‘বে’-তে বিভক্ত করেছে। বড়টি মধ্যবর্তী স্থানে (প্রতিপাশে ৫.৮৭ মি) এবং এর প্রত্যেক পাশে দুটি করে ছোট ‘বে’ যা পূর্ব-পশ্চিম অক্ষে নির্মিত। খিলানগুলি সরাসরি দুটি স্বতন্ত্র অষ্টকোণাকার স্তম্ভ এবং দেয়ালে সংযুক্ত অর্ধ অষ্টকোণাকার স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে বে’গুলিকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করে খিলানপথ তৈরি করেছে। উল্লেখ্য যে, এসকল খিলান দেয়ালের মতোই উপর পর্যন্ত বিস্তৃত যা উপরের অংশে ‘বে’ তৈরি করেছে। এ বিশেষ প্রক্রিয়া মসজিদটিকে ভেতর দিকে দ্বিতল আকার দিয়েছে। পাঁচটি ‘বে’-ই নলাকার ড্রামের উপর পদ্ম ও কলসাকৃতির ফিনিয়াল দ্বারা শীর্ষমন্ডিত গম্বুজ দ্বারা আবৃত। উপরের কোণে অর্ধগম্বুজাকৃতির স্কুইঞ্চের উপর গম্বুজগুলি স্থাপিত এবং দু স্কুইঞ্চের মধ্যবর্তী দেয়াল বদ্ধ খিলান দ্বারা উত্থিত। অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব অর্ধ অষ্টকোণাকার নকশায় তৈরি। কিন্তু পার্শ্বস্থ মিহরাব অগভীর আয়তাকার ধরনের। কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের ফ্রেমে কেন্দ্রীয় খিলানপথের মতই প্যারাপেটের প্রান্তে অষ্টকোণাকার ক্ষুদ্র বুরুজ উপরে উঠে গেছে।
ইমারতের মূল আস্তরণের স্থলে বর্তমানে আধুনিক সিমেন্ট প্লাস্টার স্থান করে নিয়েছে। অনুভূমিক প্যারাপেট বর্তমানে সমান কেন্দ্রীয় খিলান পথের ফ্রেমের সম্মুখভাগ অগভীর আয়তাকার প্যানেল দ্বারা সজ্জিত এবং প্রতিটি পরবর্তীসময়ে স্টাকো নকশার ফুলসহ ছোট গাছ এবং লতাপাতার একইরূপ মোটিফ দ্বারা অলংকৃত। কেন্দ্রীয় মিহরাব খিলান সুন্দর অলঙ্কৃত প্লাস্টার দ্বারা উত্থিত এবং স্প্যানড্রেল পত্রাকার অলঙ্করণ দ্বারা শোভিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের আয়তাকার ফ্রেম যদিও বর্তমানে অনেকটাই সমান, তবে শীর্ষে বদ্ধ মেরলোন নকশা রয়েছে। গম্বুজকে সমর্থন দানকারী স্কুইঞ্চ ও বদ্ধ খিলানের মধ্যবর্তী স্থানে মুগল স্টাকো অলঙ্করণের একটি অপূর্ব নিদর্শন এখনও বিদ্যমান রয়েছে। স্কুইঞ্চ খিলানের বহির্ভাগ এবং বদ্ধ খিলান প্যাঁচানো লতাপাতা নকশা দ্বারা অলংকৃত। যদিও বদ্ধ খিলানের মধ্যবর্তী অংশে গোলাপ নকশাসহ অল্প লতাপাতা নকশা রয়েছে এদের অল্প উপরে। ড্রামের ভিত্তির চারপাশে ফুলের লতাপাতা নকশাসহ সামান্য উত্থিত ফ্রিজ নকশা রয়েছে।
পাঁচ গম্বুজ মসজিদ বাংলার মসজিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এর আবার দুটি ধরন রয়েছে ক. একটি বৃহৎ কেন্দ্রীয় গম্বুজ ও প্রতিপাশে একই সারিতে একজোড়া ছোট গম্বুজ এবং খ. একটি কেন্দ্রীয় বৃহৎ গম্বুজ ও চারকোণে চারটি ছোট গম্বুজ। আলোচ্য মসজিদটি দ্বিতীয় ধারার মসজিদ স্থাপত্যের উদাহরণ। ইমারতটি পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজ সম্পাদনে স্থপতি এবং নকশাকারীরা তাদের সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও উদ্ভাবন কৌশলের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। মসজিদের অভ্যন্তরে পাঁচটি বর্গাকার ভাগ পূর্বপশ্চিমে প্রশস্ত খিলানের পরিবর্তে দুটি স্বতন্ত্র মজবুত অষ্টকোণাকার স্তম্ভের বিন্যাস এ ধারার পূর্ববর্তী উদাহরণ হতে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে উত্তরণ ঘটানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় এ ধারার মসজিদ নির্মিত হয় নি। কিন্তু পরবর্তীকালে কমপক্ষে দুশতক পরে এ ধারাটি পুনরায় ঢাকার বেচারাম দেউড়ি মসজিদে (১৮৭২ খ্রি.) লক্ষ করা যায়। বেচারাম দেউড়ি মসজিদটি পরিকল্পনায় আলমগীরী মসজিদটিরই অনুরূপ, কিন্তু এর মান ও গঠনশৈলীতে অসম্পূর্ণতা রয়েছে।
বাংলায় এরূপ মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়েছে অষ্টগ্রাম মসজিদ থেকে, সরাইল হাটখোলা মসজিদ এ এর বিস্তৃতি ঘটে এবং ওয়ালিপুর আলমগীরী মসজিদে এ ধারা প্রকৃত আদর্শ রূপ লাভ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলার মসজিদের এ নির্দিষ্ট ধারাটির মূল উৎস কোথায়? এ রীতি কি বাংলার স্থপতিরা বাইরের দেশ হতে এনেছেন নাকি এটি বাংলার স্থপতিদের একটি উদ্ভাবন ছিল? তুরস্কে প্রাথমিক অটোম্যানদের সময়ে তোকাতে অবস্থিত রুস্ত্তম সেলিরি’র মসজিদ (আনু. পনেরো শতকের প্রথমার্ধ), বড় একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ এবং চারকোণে একটি করে ছোট গম্বুজসহ মোট পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের এ ধারায় প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। একই পরিকল্পনা অটোম্যানদের অন্যান্য মসজিদেও লক্ষ করা যায়। যেমন, হায়রাবুল’র গুজেলচি হাসান বে মসজিদ (১৪০৬) এবং এদিরনের উচ-সেরেফেলি চাম (১৪৩৭-৪৭) মসজিদ। পরবর্তীকালে নির্মিত ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত বায়েজীদ মসজিদ (১৫০১-০৬), সুলায়মানিয়া মসজিদ (১৫৫০-৫৯) এবং এদিরনে’র অপরূপ সেলিমিয়া মসজিদ (১৫৬৯-৭৫) এ ধারার কাছে ঋণী। পাঁচ কক্ষ বা পাঁচগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ পরিকল্পনায় নির্মিত অটোম্যান মসজিদগুলি সম্ভবত সিরিয়ায় প্রাথমিক কিছু ইমারতের অনুকরণে তৈরি।
ভারতের দিল্লিতে জামাত খান মসজিদ (১৩১০-১৬ খ্রিস্টাব্দ) এ ধারার একমাত্র উদাহরণ। একটি বৃহৎ কেন্দ্রীয় গম্বুজাবৃত কক্ষের সঙ্গে দুটির পরিবর্তে চার গম্বুজসহ আগ্রায় হুমায়ুনের মসজিদ (১৫৩০) প্রতিষ্ঠার পর হতে পূর্ব ভারতে এ ধারার মসজিদ নির্মাণ বিস্তৃতি লাভ করে। সুতরাং এটা বলা যেতে পারে যে, বাংলায় দ্বিতীয় ধারার পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা বাংলার স্থপতিদের নিজস্ব উদ্ভাবন ছিল না এবং উপরিউক্ত উৎসসমূহ হতে সম্ভবত এটি এসেছে, বিশেষ করে হয়তো তুরষ্ক ও উত্তর ভারত হতে। [এম.এ. বারি]