ইসলাম, সৈয়দ আশরাফুল

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

ইসলাম, সৈয়দ আশরাফুল (১৯৫২-২০১৯) জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মাতা সৈয়দা নাফিসা ইসলাম দম্পতির ৬ সন্তানের মধ্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন বয়োজেষ্ঠ। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১লা জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলপড়ুয়া ছাত্র থাকাকালেই ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগের পতাকাতলে একাত্ম হয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে ডাঃ হাফিজ খান ও খালেদ খুররম-এর নেতৃত্বাধীন জেলা ছাত্রলীগ কমিটির দফতর সম্পাদক, এস.এস.সি পেরিয়ে আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রাবস্থায় মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা ও সাখাওয়াত হোসেন-এর নেতৃত্বাধীন জেলা ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পান। তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিমউদ্দিন আহম্মেদ। বিএলএফ-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অগণিত ছাত্রজনতাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তিনি নিজে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলনে বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শেখ শহিদুল ইসলাম ও এম.এ রশিদ-এর নেতৃত্বাধীন কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে আসীন হন। পিতার ইচ্ছায় ১৯৭৩ সালে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে লন্ডন গিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের পরে (২০০৭) যখন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল গ্রেফতার হন, তখন সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে ২৪শে জুলাই, ২০০৯ এবং ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১২ সালের কাউন্সিলে দুই দফায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সম্মেলন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এসবের আগে ২০০২ সালের ২৬শে ডিসেম্বরের কাউন্সিলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। পিতার মৃত্যুর আগে থেকেই তিনি লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে বসবাস করছিলেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। আশরাফুল ফেডারেশন অব বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফ.বি.ওয়াই.ইউ)-এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং তাঁর পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে বিদেশে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।

১৯৯৬ সালে আশরাফুল দেশে ফিরে আসেন এবং ১২ই জুন ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে তিনি প্রথমবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গঠিত মন্ত্রিসভায় তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চতুর্থবার একই সংসদীয় এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

২০১৫ সালের ৯ই জুলাই থেকে এক মাস এক সপ্তাহ দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিজের অধীনে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। তিনি অসুস্থতাজনিত কারণে বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকলেও ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮-এ অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন। শপথ গ্রহণের আগেই তিনি প্রয়াত হন। ওয়ান ইলেভেন (২০০৭) পরবর্তী আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ২০০৯-২০১৩) সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। দলকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একই সময়ে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের যে অপচেষ্টায় সামরিক জান্তা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তিনি তা রুখে দিয়েছিলেন।

ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সৈয়দ আশরাফ থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি ২০১৬ সালের ১৮শে সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বনানী বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে।

ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং সহোদর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-এর উত্তরসূরী হিসেবে কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা) আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ২০১৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রীমা ইসলাম নামে তাদের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। [সাব্বীর আহমেদ]