ইসলাম, নুরুল
ইসলাম, নুরুল (১৯২৯- ২০২৩) অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং লেখক। নুরুল ইসলাম জন্মেছিলেন ১৯২৯ সনের ১লা এপ্রিল এবং বেড়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন স্কুলমাস্টার। বাবার উপর্যুপরি বদলির কারণে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তুলনামূলক দেরিতে শুরু হয়। ‘An Odzssey: The Journey of My life’ নামক আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেন যে, হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া অবধি বাবার কাছে ঘরোয়াভাবে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরে তিনি ১৯৫৫ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
পিএইচ.ডি শেষ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ১৯৬০ সালে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। অন্যান্য অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন বেগবান করতে কাজ করেন। নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, এবং হাবিবুর রেহমান কর্তৃক আয়োজিত একটি সেমিনারে ১৯৬১ সালে উত্থাপিত হয় ‘দুই অর্থনীতি তত্ত্ব’, যাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরা হয়। ড. নুরুল ইসলাম ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিক্স (PIDE)-এর পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন; প্রতিষ্ঠানটির পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (BIDS) নামে রূপান্তরিত হয়।
নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাম্পেইন করেন। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘মুজিবনগর সরকার’ কর্তৃক গঠিত পরিকল্পনা কমিশনের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর চেয়ারম্যান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্থাীয়ভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অর্থনীতি ও সামাজিক পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন, এবং পরবর্তীতে সেখানকার ইমেরিটাস ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট অ্যান্টনি কলেজেরও ফেলো নির্বাচিত হন। ইয়েল, ক্যামব্রিজ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স এবং নেদারল্যান্ডস স্কুল অব ইকনমিক্স ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। জাতিসংঘের উন্নয়ন পরিকল্পনানীতি কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ১৯৭৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর জেনারেলের সিনিয়র উপদেষ্টা, এবং পরবর্তীতে একজন ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি মোট ২৯টি বই লিখেছেন, যেগুলোর মধ্যে Corruption, Its Control and Drivers of Change, India, Pakistan, Bangladesh: A Primer on Political History, Development Planning in Bangladesh: A Studz in Political Economy (UPL, 1979, reprint 1993), Development Strategy of Bangladesh (Pergamon, 1978), Foodgrain Price Stabilization in Developing Countries: Issues and Experiences in Asia (IFPRI, 1996), Exploration in Development Issues: Selected Articles of Nurul Islam (Ashgate, 2003) and Making of a Nation-Bangladesh: An Ecnomist Tale (UPD 2003) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক অর্থনীতিতে বিশেষ অবদানের জন্যে ২০০৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক পদক লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ২০১৩ সালের ইউও আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।
তিনি ৮ই মে ২০২৩ সালে ৯৪ বছর বয়সে ইউএস-এর ওয়াশিংটন ডিসিতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। [গোবিন্দ চক্রবর্তী]]