ইলেকট্রনিক্স
ইলেকট্রনিক্স (Electronics) তড়িৎ প্রকৌশলের প্রধান শাখাগুলির একটি, যা পরিবাহী ও অর্ধপরিবাহী থেকে ইলেকট্রনের নিঃসরণ, এ ইলেকট্রনগুলির পরবর্তী সুবিধাজনক ব্যবহার এবং ইলেকট্রনিক যমত্র নির্মাণ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে। প্রথম ইলেকট্রনিক যন্ত্র ছিল থার্মোনিক ভাল্ভ বা ভ্যাকুয়্যাম টিউব, যার ভিতরের শূন্যস্থানে ইলেকট্রনগুলি ছুটোছুটি করে এবং এটি বেতার, টেলিভিশন, রাডার ও ডিজিটাল কম্পিউটারের মতো উদ্ভাবনগুলির প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৪৮-এর দিকে ট্রানজিস্টারের উদ্ভাবন এবং পরবর্তী সময়ে ইনটিগ্রেটেড সার্কিট (IC)-এর বিকাশ ইলেকট্রনিক্সের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে এবং এগুলি সবই পূর্বের ইলেকট্রন টিউব প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিগুলি সব সূক্ষ্ম সিলিকন চিপ-এর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। সিলিকন চিপ এক প্রকার অতি পাতলা বিস্কুটের মতো ক্রিস্টালের ফালি/স্লাইস যা অন্তত ১০ হাজার ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্ট ধারণ করে। এ ধরনের উন্নয়ন ইলেকট্রনিক সার্কিটকে অধিক ঘনত্বসম্পন্ন বিন্যাসে সাজাতে সাহায্য করেছে এবং যন্ত্রের আকার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করতে সহায়তা করেছে। এর ফলে সম্ভব হয়েছে ঘনবিন্যস্ত ক্ষুদ্রাকৃতির কম্পিউটার, উন্নত রাডার ও দিক বা অবস্থান নির্ণয় ব্যবস্থা এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরি যেগুলিতে বিপুল সংখ্যক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হয়। সিলিকন চিপের উন্নয়নের জন্যই ভোক্তারা পেয়েছে আরও ছোট কিন্তু অধিকতর নির্ভরযোগ্য বেতার ও টেলিভিশন, উন্নত শব্দ ও ভিডিও রেকর্ডিং এবং পুনরুৎপাদন ব্যবস্থা, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, সেলুলার টেলিফোন এবং শক্তিশালী অথচ কম খরচের পিসি-র মতো উন্নণত প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক সামগ্রী গুলি।
১৯৩০ সালে বেতার কেন্দ্র ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন এবং ওয়ারলেস যোগাযোগের ক্ষেত্রে এদেশে প্রথম ইলেকট্রনিক্সের ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক প্রয়োজনে ওয়ারলেস যোগাযোগ প্রযুক্তি আরও উন্নত হয় এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি প্রথমে ভারতে পরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৬০ সালে এদেশে খুবই উচ্চ কম্পাঙ্ক অর্থাৎ ভি.এইচ.এফ (Very High Frequency) প্রযুক্তির টেলিফোন স্থাপন করা হয় যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালে টেলেক্স/টেলিপ্রিন্টার সেবা প্রবর্তন করা হয়। প্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৮৩-তে ডিজিটাল প্রযুক্তির টেলিফোন এবং ১৯৯২-তে মোবাইল (সেলুলার) ফোন প্রযুক্তি প্রবর্তিত হয়।
বেতার, টেলিভিশন, অডিও-ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার ও প্লেয়ার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, তারবিহীন টেলিফোন, ইত্যাদি বাংলাদেশে গার্হস্থ্য জীবনে বহুল ব্যবহূত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির উদাহরণ। ১৯৮০-র পূর্বে এক ব্যান্ড বেতারযন্ত্র ছাড়া অন্য সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যাদি আমাদানি করা হতো। কিন্তু ১৯৮০-র পর বেতারযন্ত্র, টেলিভিশন, অডিও-ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার ও প্লেয়ার ত্যাদি উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু যন্ত্রাংশ সংযোজন কেন্দ্র (assembly plants) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০-এর পর থেকে
কম্পিউটার, তারবিহীন টেলিফোন, স্যাটেলাইট টেলিভিশন সংকেত গ্রাহক যন্ত্র ইত্যাদির মতো আধুনিকতম জটিল যন্ত্রপাতি সংযোজন দেশেই সম্পন্ন করা হচ্ছে এবং কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদনও করা হচ্ছে। কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি তাদের যন্ত্রাংশ প্রস্ত্তত ও সংযোজন কেন্দ্র এদেশে স্থাপন করেছে। বিদেশি কোম্পানিগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় কোম্পানিগুলিও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে যন্ত্রাংশের শিল্পোৎপাদন ও যন্ত্রাংশ সংযোজন কারখানা। বর্তমানে এ কোম্পানিগুলির মোট সংখ্যা ৬০-এর অধিক। স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে এক/বহু ব্যান্ড বেতারযন্ত্র, অডিও ও ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার এবং প্লেয়ার ইত্যাদির চাহিদা পূরণ হচ্ছে এবং টিভির জন্য, বিশেষত রঙিন টিভির প্রায় ৫০% চাহিদা পূরণ হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। তবে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রনিক ক্যামেরা, প্রজেক্টর ইত্যাদির মতো অত্যাধুনিক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতিগুলি এখনও আমদানি করা হচেছ। ১৯৯৪-এ বাংলাদেশের মুক্ত বাজার চুক্তিতে সই করার সময় থেকে সকল প্রকারের ইলেকট্রনিক পণ্যদ্রব্য এদেশে স্বাধীনভাবে আমদানি করা হচেছ। [এম কামরুজ্জামান]