ইমাম, হোসেন তৌফিক

ইমাম, হোসেন তৌফিক (১৯৩৭-২০২১) এইচ.টি ইমাম নামে সর্বজন পরিচিত। ডাকসাইটে আমলা, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব (১৯৭১), প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথমে জনপ্রশাসন পরে রাজনৈতিক উপদেষ্টা। এইচ.টি ইমাম ১৯৩৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। তাঁর পিতার নাম তাফসির উদ্দিন আহমেদ ও মাতার নাম তাহসিম খাতুন। পিতা পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মাতা ছিলেন গৃহিনী। ১০ ভাইবোনের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল সর্বকনিষ্ঠ। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৪ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৮ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ সালে London School of Economics and Political Science (LSE) থেকে ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিক্সে পোস্ট-গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা অর্জন করেন।

হোসেন তৌফিক ইমাম

রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মময় জীবন শুরু। অতঃপর ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সিএসপি অফিসার হিসেবে নতুন কর্মময় জীবন শুরু করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান)-এর ডিসি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। সে অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি প্রথমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে তিনি আসাম থেকে কলকাতা পৌঁছেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগ দেন। মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক বিভিন্ন শাখা ও মুক্ত অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠিত হলে তিনি ঐ সরকারেরও মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন ও নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর চাকরি জীবনে সড়ক ও সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব, প্লানিং ডিভিশনের সচিব, প্লানিং কমিশনের সদস্য, পিএটিসি’র প্রকল্প পরিচালক, যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের কার্যনির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে তিনি অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস উল্লাপাড়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ অত্র এলাকার সার্বিক উন্নয়নেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাঁর দ্বিতীয় দফা সরকার গঠিত হলে, এইচ.টি ইমাম মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োজিত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত একই পদে আসীন ছিলেন। ২০২১ সালের ৪ঠা মার্চ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি দুটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন: বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ (ঢাকা ২০১২) এবং বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১-৭৫ (ঢাকা ২০১৩)। ১৯৫৭ সালে ইসমত আরা বেগমের সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইসমত আরা বেগম ২০০০ সালে পরলোকগমন করেন। এইচ.টি ইমাম-ইসমত আরা দম্পতির এক পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র এইচ.টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ (ঢাকা ২০১২); এইচ.টি ইমাম, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু: প্রাসঙ্গিক ভাবনা (ঢাকা ২০১৮)