আহল-ই-হাদীস

আহল-ই-হাদীস বলতে হাদীস ও সুন্নাহভিত্তিক শরী’আতের অনুসারীদের বোঝায়। হাদীসের একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে আহল-ই-হাদীস-এর অনুসারীরা ব্যাপক অর্থ ও তাৎপর্যেই হাদিসকে গ্রহণ করেন এবং দাবি করে থাকেন যে, তাঁরা সহীহ্ (নির্ভরযোগ্য) হাদীসের অনুসারী। এ ভাবধারা প্রধানত এ উপমহাদেশে প্রায় দু’শ বছর ধরে চলে আসছে।

আহল-ই-হাদীস-এর উদ্যোক্তাগণ রায় বেরিলির সৈয়দ আহমদ শহীদের তরীকাহ-ই মুহম্মদিয়া আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। পরবর্তীকালে পাটনার মওলানা বিলায়াত আলী সাদিকপুরী, মওলানা সৈয়দ মিয়া নাযীর হুসায়ন দেহলভী ও ভূপালের নবাব সিদ্দীক হাসান খান এ আন্দোলনকে পূর্ণ রূপ দেন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গোটা ব্রিটিশ ভারত জুড়ে এ আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। আহল-ই-হাদীস-এর মতে, এর অনুসারীরা নীতি ও আদর্শের মাধ্যমে নিষ্ঠাবান ধার্মিক মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের জীবনধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলিক নীতিমুখী ইসলামী পুনরুজ্জীবনের সূচনা করেন। অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন ও মাযহাবের তুলনায় হাম্বলী মাযহাবের সঙ্গে আহল-ই-হাদীস-এর অনেক মিল রয়েছে। অবশ্য আহল-ই-হাদীস-এর অনুসারীরা কোনো মাযহাবের সঙ্গে নিজেদের চিহ্নিত করতে চান না। ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন হিসেবে আহল-ই-হাদীস মহানবী (সঃ)-এর সুন্নাহর অনুশীলনে নিষ্ঠাবান।

আহল-ই-হাদীস-এর অনুসারীগণ পূর্ববর্তী শীর্ষস্থানীয় প্রবক্তাদের প্রণীত কঠোর ও অপরিবর্তনীয় নীতিমালার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকে হাদীস অনুসারীরা মুসলমানদের জীবন ধারাকে প্রধানত দু’টি ধারায় বিভক্ত করেন: (১) আহল-ই-হাদীস- যারা মাযহাবের অনুসরণ করেন না এবং (২) আহল-ই-সুন্নত ওয়াল জামাআত - যারা মাযহাবের অনুসারী।

উপমহাদেশে আহল-ই-হাদীস-এর সমসাময়িক প্রবক্তারা জোরালোভাবে এ আন্দোলনকে লাগাতার ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করেন। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী বলেন, ভারতের আহল-ই-হাদীস আন্দোলন চার স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: (ক) বিশুদ্ধ একত্ববাদে বিশ্বাস, (খ) মহানবী (সঃ)-এর সুন্নাহর অনুসরণ, (গ) জিহাদ অথবা ধর্মযুদ্ধের জন্য উদ্যম, এবং (ঘ) আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ।

আহল-ই-হাদীস সকল বিষয়ে কেবল পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষপাতী। তাঁরা কিয়াস বা সাদৃশ্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন না।

ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর আহল-ই-হাদীস আন্দোলন পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচিকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে লাহোরে ‘‘পাকিস্তান মারকাজ-ই-জাম‘ইয়াত-ই-হাদিস’’ গঠিত হয়।

১৯১৪ সালে মওলানা সৈয়দ মিয়া নাযীর হুসায়নের বাঙালি ও আসামী ছাত্ররা বাংলা ও আসামে ‘আঞ্জুমান-ই-হাদিস’ গড়ে তোলে। ১৯১৬ সাল থেকে এটি সর্বভারতীয় আহল-ই-হাদীস সম্মেলনের শাখা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৪৬-এ কলকাতায় মওলানা আবদুল্লাহি’ল কাফী’র (১৯০০-১৯৬০) নেতৃত্বে নিখিল বঙ্গ ও আসাম জাম‘ইয়াত-ই-হাদিস গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের পর এ সংগঠনের কেন্দ্র কলকাতা থেকে পাবনায় স্থানান্তরিত হলে ১৯৫১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘আঞ্জুমান-ই-আহল-ই-হাদীস’ গঠিত হয়। অন্যদিকে, পাবনাস্থিত ‘নিখিল-বঙ্গ ও আসাম জাম‘ইয়াত-ই-আহল-ই-হাদীস ১৯৫৩ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান জাম‘ইয়াত-ই-আহল-ই হাদিস’-এ রূপান্তরিত হয় এবং এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় দপ্তর ১৯৫৬ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের নাম হয়েছে বাংলাদেশ ‘জাম‘ইয়াত-ই-আহল-ই-হাদীস’।  [সম্পাদকীয় কমিটি]