আহমেদ, মহিউদ্দীন১

আহমেদ, মহিউদ্দীন (১৯২৫-১৯৯৭) পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী, ন্যাপ, বাকশাল ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনশন পালনকারী।

মহিউদ্দীন আহমেদ

বৃহত্তর বরিশাল জেলার পিরোজপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শহরে ১৯২৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি মহিউদ্দীন আহমেদের জন্ম। ছোটবেলা তাঁর ডাক নাম ছিল পান্না মিয়া। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি মঠবাড়িয়া উপজেলার গুলিশাখালি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আজহারউদ্দিন আহমদ এবং মাতার নাম নুরুন্নাহার বেগম। আজাহারউদ্দিন আহমদ প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন কুসংস্কারমুক্ত। তিনি দুবার (১৯২১ ও ১৯২৩) বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

মহিউদ্দীন আহমেদের শৈশবের কিছু সময় কাটে পিরোজপুর শহরে এবং কিছু সময় নিজ গ্রামে। নিজেদের বাড়িতে পাঠশালায় পণ্ডিতের কাছে তাঁর লেখাপড়া শুরু। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন গুলিশাখালি জুনিয়র মাদ্রাসায়। এরপর মঠবাড়িয়া লতিফ হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি কলকাতায় চাকরিজীবী বড় ভাইয়ের কাছে চলে যান। তাঁকে বালিগঞ্জ সরকারি ডেমোনস্ট্রেটিভ হাইস্কুলে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪২ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। এরপূর্বে তিনি কিছুকাল খুলনার দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি ও ভারতের এলাহাবাদ ইয়ং ক্রিশ্চিয়ন কলেজে ইন্টারমেডিয়েট ক্লাসে পড়াশুনা করেন। তাঁর অগ্রজ সহোদর ভ্রাতা এম ইউ আহমদ তখন এলাহাবাদের ঐ কলেজে প্রভাষক। ১৯৪৮ সালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে বি.এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন।

মহিউদ্দীন আহমেদ অন্যান্য ভাইদের মতো চাকরিকে পেশা হিসেবে বেছে না নিয়ে রাজনীতির পথ বেছে নেন। তিনি ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। পিতার কারণে অপেক্ষাকৃত কম বয়স থেকেই তিনি রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। তখনকার অন্যান্য তরুণদের মতো তাঁর ভেতরও ব্রিটিশবিরোধী চেতনা সৃষ্টি হয়। স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এক পর্যায়ে তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪০ সালে তিনি নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে কলকাতায় ‘হলওয়ে মনুমেন্ট’ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি একই সঙ্গে জেলা মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলন ও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালের পূর্ব থেকেই বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ অভ্যন্তরীণভাবে দ্বি-ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে, যথা সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপ বনাম খাজা নাজিমউদ্দিন-আকরম খাঁ গ্রুপ। তিনি শেষের ধারার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। খাজা নাজিমউদ্দিন-নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন সরকারি মুসলিম লীগের উপদলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে তিনি দল থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে ১৯৫২ সালে তিনি ও বঙ্গবন্ধু প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, তারপর ফরিদপুর কারাগারে সহবন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপ সমর্থক। দল থেকে বহিষ্কার, কারাবন্দিত্ব ইত্যাদির ফলে মহিউদ্দীন আহমেদের মধ্যে এ সময় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রেষারেষি থাকলেও, একই সময় কারাবন্দি থাকা অবস্থায় উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা উভয়ে ফরিদপুর কারাগারে অনশন পালন করেন। একটানা দীর্ঘ ২৬ মাস কারাবন্দি ও ১১ দিনের অনশন শেষে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির হুকুম আসলে তিনি মহিউদ্দীন আহমেদের হাতে ডাবের পানি পান করে অনশন ভঙ্গ করেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এবং পরের দিন মহিউদ্দীন আহমেদ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পূর্বাপর সম্পর্ক-সম্বন্ধ, কারাগারে একসঙ্গে অনশন পালন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

কারামুক্তির পর মহিউদ্দীন আহমেদ বামপন্থী রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকে সামনে রেখে এর পূর্বের বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকায় বামপন্থী কর্মীদের এক সম্মেলনে প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশকে সভাপতি করে গণতন্ত্রী দল গঠিত হলে, মহিউদ্দীন আহমেদ এ দলে যোগ দেন। এটি যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি এ দল থেকে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে এমপিএ নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে গণতন্ত্রী দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে বামপন্থী সমর্থকদের নিয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে, তিনি এ দলে যোগ দেন এবং যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর হুলিয়া নিয়ে তিনি একই বছর শেষের দিকে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৬৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মুক্তিলাভ করেন। ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে রাশিয়া বনাম চীন এ দু’ধারায় বিভাজনের অনুকরণে ন্যাপে বিভক্তি দেখা দিলে মহিউদ্দীন আহমেদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী ন্যাপে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব বা ‘সিস্টেম চেইঞ্জের’ লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দলকে একত্রিত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করলে তিনি এ দলের ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে (আগস্ট ১৯৭৫) স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও নতুন করে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মহিউদ্দীন আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়ার শাসনকালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন এবং সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২-১৯৯০ পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলন চলাকালে ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ নিয়ে বের হয়ে গিয়ে বাকশাল গঠিত হলে মহিউদ্দীন আহমেদ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে দলবল নিয়ে তিনি ও আবদুর রাজ্জাক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

১৯৯৭ সালের ১২ই এপ্রিল এ বরেণ্য রাজনীতিবিদের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর স্ত্রীর নাম রেবেকা বেগম। তিনিও প্রয়াত। এ দম্পতি ১ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র মহিউদ্দীন আহমেদ, আমার জীবন আমার রাজনীতি (আগামী প্রকাশনী ২০০২); শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, (ইউপিএল ২০১২); হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ, (ইউপিএল ২০১৩), হারুন-অর-রশিদ, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব: কী ও কেন, (বাংলা একাডেমি ২০২০)।