আহমেদ, মওদুদ
আহমেদ, মওদুদ (১৯৪০-২০২১) বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, দক্ষ সাংসদ এবং লেখক ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সালের ২৪ মে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা মমতাজ উদ্দীন আহম্মেদ একজন সুফী ইসলামিক পণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা বেগম আম্বিয়া খাতুন গৃহিনী ছিলেন। মওদুদ আহমেদ তাঁর পিতামাতার ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সম্মান পাশ শেষে ব্রিটেনের লন্ডনে অবস্থিত লিংকস ইন থেকে 'বার-অ্যাট-ল' ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। রাজনীতি, আইন পেশা, লেখালেখি এবং বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেও রাজনীতিবিদের পরিচয়েই তাঁকে আলোচিত করেছে।
মওদুদ আহমেদ স্কুল ছাত্র থাকাকালীন বাংলা ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে জেল খেটেছিলেন। পরে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় কলেজের ছাত্র সংসদের আপ্যায়ন সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে ফরমান উল্লাহ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত খেলাফত রাব্বানীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শক্তির সাথে জড়িত ছিলেন।
মওদুদ আহমেদ, 'বার-অ্যাট-ল' শেষ করে ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফেরেন এবং ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা ঘোষণা করলে তাঁর সমর্থনে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যে ডিফেন্স কমিটি গঠিত হয় তার অন্যতম সদস্য ছিলেন। একজন আইনজীবী এবং অরাজনৈতিক, অবৈতনিক সচিব হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে থেকেছেন। আইয়ুব খানের সাথে দুই দফা গোল টেবিল বৈঠকে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মওদুদ আহমেদ প্রবাসী সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগ গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। সে সময়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে জনমত সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ নামে একটি ইংরেজি মুখপত্র নিয়মিত প্রকাশ করার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অন্যতম একজন ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ পরবর্তী পটপরিবর্তন উত্তর বাংলাদেশে মওদুদ আহমেদ বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারে নিজেকে যুক্ত করে তিনি নানা সময়ে শিল্প, পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ, পানি সম্পদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, রেল ও সড়ক যোগাযোগ, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৭-৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ১ম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৫ সালে নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাকে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ১৯৮৬ সালে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার তাঁকে উপ-রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব দেন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ সরকারের পতন হলে জেলে যান। পরবর্তীতে তিনি জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে সংযুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতা হন। ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মওদুদ আহমেদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, উন্নয়ন এবং গণতন্ত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy (১৯৭৬), Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman (১৯৮৩), Democracy and the Challenge of Development – A Study of Politics and Military Interventions in Bangladesh (১৯৯৫), South Asia Crisis of Development: The Case of Bangladesh (২০০২), Bangladesh: A Study of the Democratic Regimes (২০১২) and Bangladesh: Emergency and the Aftermath 2007-2008 (২০১৪).
মওদুদ আহমেদ লেখালেখির পাশাপাশি বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলো এবং ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কন্যা হাসনা জসীমউদ্দীনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি তিন সন্তানের জনক ছিলেন।
২০২১ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [গোবিন্দ চক্রবর্তী]