আহমদ, সাঈদ
আহমদ, সাঈদ (১৯৩১-২০১০) নাট্যকার, চিত্রসমালোচক, শিক্ষাবিদ। জন্ম পুরানো ঢাকার ইসলামপুরে ১ জানুয়ারি ১৯৩১। পিতা মীর্জা এফ মোহাম্মদ, মাতা জামিলা খাতুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর (১৯৫৪) এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট (১৯৫৬) ডিগ্রি লাভ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।
সাঈদ আহমদের ইচ্ছা ছিল তিনি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পী হবেন। কিন্তু আধুনিক সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় (১৯৫০) তিনি ‘সাঈদ আহমদ ও সম্প্রদায়’ নামে একটি দল গঠন করেন, যে-দলটি নাজিম উদ্দিন রোডের ও দেওয়ানবাজার রেডিও স্টেশন থেকে নিয়মিত অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করতো। অনুষ্ঠানটির পরিচালক ছিলেন সাঈদ আহমদ এবং স্ক্রিপ্ট লিখতেন কবি শামসুর রাহমান। ১৯৫৪ সালে সাঈদ আহমদ লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস-এ পড়তে যান। সেখানে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মিউজিক শিক্ষা শুরু করেন। বিবিসির Part-timer হিসেবে তিনি সেতার ও অর্কেস্ট্রা বাজাতেন উর্দু সার্ভিস, বাংলা সার্ভিস, ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস, শ্রীলংকা সার্ভিস-এ। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গেও তিনি সেতার বাজিয়েছেন।
১৯৫৬ সালে সাঈদ আহমদ লাহোরে চলে আসেন সরকারি চাকরি সূত্রে। এখানে তিনি অ্যাবসার্ড ধারার নাটক লিখতে শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে এ রকম নাট্যচর্চার শুরু হয়। সাঈদ আহমদকে বাংলা ‘থিয়েটার অফ দি অ্যাবসার্ড’ নাট্যধারার পুরোধা বলা যেতে পারে। ১৯৬১-৬২ সালে এক বছর ধরে তিনি লিখেন, The Thing বাংলায় কালবেলা, ১৯৭৬২-৬৪ রচনা করেন The Milepost; ১৯৬৪-৬৬-তে রচনা করেন Survival বাংলায় তৃঞ্চায়। তাঁর অপর দুটি বাংলা নাটক একদিন প্রতিদিন (১৯৭৪) ও শেষ নবাব (১৯৮২)। তাঁর নাটক অনূদিত হয়েছে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয়, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায়। তিনি চিত্রকলার সমালোচক হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। চিত্রকলা বিষয়ক তাঁর প্রকাশনার মধ্যে আছে, Art in Bangladesh (1976), Painting in Bangladesh (1976), Five painters of Bangladesh (1979), Contemporary Art (1980), Contemporary Graphic Arts of Bangladesh (1996)। নাট্যকার, চিত্র-সমালোচক ও সংস্কৃতিবেত্তা হিসেবে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশে লেকচার দিয়েছেন তার মধ্যে আছে নেপাল, ইউএসএ, হংকং, সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব জার্মানি, ব্রাজিল, জাপান, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, নরওয়ে, চীন, ভারত ও হল্যান্ড। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে যেসব দেশ ভ্রমণ করেন তার মধ্যে আছে জাপান, হংকং, চায়না, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, তুরস্ক, সুইডেন, ডেনমার্ক, ব্রাজিল, সোভিয়েত রাশিয়া, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, পশ্চিম জার্মানি এবং ভারত।
১৯৮২ সালে সাঈদ আহমদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বিশ্বনাটক’ অনুষ্ঠান শুরু করেন। অনুষ্ঠানটির শুরুতে তিনি বিশ্বের খ্যাতিমান নাট্যকারদের জীবনী উপস্থাপন করতেন এবং পরে দেখানো হতো নাটক। মাত্র চারটি নাটক প্রচারিত হবার পর ‘বিশ্বনাটক’ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু বিটিভিতে মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেবার পর তাঁকে অনুষ্ঠানটি বন্ধ করতে হয়। ১৯৮৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবার পর আবার তিনি বিটিভিতে ‘বিশ্বনাটক’ প্রচার শুরু করেন। প্রতি মাসে ১২টি করে নাটকসহ মোট ৭১টি নাটক প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ও উল্লেখযোগ্য নাট্যকারদের নাটক প্রচার করা হতো। মূলত আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার দেশগুলির নাটক নিয়ে অনুষ্ঠান করতেন তিনি। বিশ্বের খ্যাতিমান নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিল্প সমালোচকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৭৬ সালের দিকে আইএমএফএ কাজ করার সময় সাঈদ আহমদ জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির গেস্ট লেকচারার ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। সাঈদ আহমদ-এর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা (২০০৩), জীবনের সাতরং (২০০৭) ও ঢাকা আমার ঢাকা (২০১০) প্রধান।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্যে সাঈদ আহমদ বেশ কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), ফরাসি সরকারের লিজিয়ন দ্য অনার (১৯৯৩), চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক (২০০৮), আব্দুল জববার খান স্বর্ণপদক (১৯৯৫), নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী (১৯৯৭), লোকনাট্যদল পদক (১৯৯৬), একুশে পদক (২০১০) উল্লেখযোগ্য। তিনি ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকায় মারা যান। [আবু সুফিয়ান কবির]